বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে সার, ডিলারদের কারসাজিতে ভুগছে কৃষক
জামালপুরের কৃষক আব্দুল জলিল গত সপ্তাহে তার আশেপাশের বেশ কয়েকটি সারের দোকানে মিউরেট অফ পটাশ (এমওপি)-এর খোঁজ করেছিলেন, তবে বেশিরভাগ দোকানেই তিনি এই সার পাননি। বহু খোঁজাখুঁজির পর যখন এক দোকানে সারটি পেলেন, বিক্রেতা ৫০ কেজি বস্তার দাম চাইলো দেড় হাজার টাকা। আব্দুল জলিল জানান, সাধারণ সময়ে এই সারের দাম আসলে সাড়ে ৭০০ টাকা।
সারাদেশের কৃষকদের অভিযোগ, চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছেন না তারা। আর যেখানে পাচ্ছেন, সেখানে থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতদিন এই সংকট শুধু ইউরিয়াতে থাকলেও এখন সেটি মিউরেট অব পটাশ বা এমওপিতেও দেখা যাচ্ছে।
রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী, জামালপুর, বরিশাল, বরগুনাসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার ইউরিয়া সারের দাম ৬ টাকা বাড়ানোর পর ৫০ কেজির বস্তার দাম হয় ১ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে কৃষককে এই সার কিনতে হচ্ছে অঞ্চলভেদে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে সারের কোনো ঘাটতি নেই, কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে।
ডিলাররা বর্তমানে ৫০ কেজির একটি বস্তা থেকে ১০০ টাকা কমিশন পান। তবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণ দেখিয়ে তারা এই কমিশন ২০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছেন।
তেলের দাম বাড়ানোর পর ডিলারদের পরিবহন খরচ বেড়েছে মাত্র ১৫ থেকে ২০ পয়সা। অর্থাৎ, ৫০ কেজির বস্তা পরিবহনের খরচ বেড়েছে ১০ টাকা।
সারের দাম বৃদ্ধির পেছনে পুরোটাই ডিলারদের কারসাজি বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় ডিলারদের আশ্বস্ত করেছিল, তাদের জন্য কমিশনের একটি নতুন বর্ধিত হার পরবর্তীতে নির্ধারণ করা হবে; সে পর্যন্ত যেন বিদ্যমান হারেই সার বিক্রি চালিয়ে যান তারা। কিন্তু অসাধু ডিলাররা মন্ত্রণালয়ের সেই আবেদনে কর্ণপাত না করেই যথেচ্ছভাবে দাম বাড়িয়েছে।
এ কারণে মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে ৩০ আগস্ট সারাদেশের ৩৮৩ জন ডিলারকে ৫৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ডিলারকে জরিমানা করা হয়েছে যশোরে। বগুড়া ও রংপুরের দুই ডিলারের লাইসেন্স বাতিলেরও প্রক্রিয়া চলছে।
বর্তমানে সারাদেশে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি সার ডিলার রয়েছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, সম্প্রতি জামালপুরে সারের সংকট বেশি। এই জেলায় ডিলারের সংখ্যা ২৫৭ জন; তারা সবাই যমুনা ফার্টিলাইজার সার কারখানা থেকে সার নেন। তবে তিন মাসের বেশি সময় ধরে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপদন বন্ধ রয়েছে কারখানাটিতে।
এই জেলার বেশির ভাগই ভিআইপি ডিলার বা স্থানীয় রাজনীতিবিদ। সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যহত হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি থেকে বরাদ্দকৃত সারের অর্ধেক নিতে বলা হলে ওই ডিলাররা তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। মূলত এ কারণেই জেলায় সারের সংকট দেখা দিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ শাখার অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ হাজরা টিবিএসকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
বরগুনা ও বরিশালের ডিলারদেরকেও চট্টগ্রাম থেকে সার তোলার কথা বলা হয়েছে। তবে তারা সেটি না করায় সেখানেও দেখা দিয়েছে সারের সংকট।
এর আগে, গ্যাসের অভাবে তিনটি কারখানা বন্ধ হলেও এখন যমুনা বাদে সবগুলো কারখানাই চালু রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) কর্মকর্তারা।
বিসিআইসি'র পরিচালক (বাণিজ্য) ও যুগ্ম সচিব কাজী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "ইউরিয়ার কোনো সংকট নেই। যমুনা ছাড়া সবগুলো কারখানাই উৎপাদনে আছে, বাইরে থেকে আমদানিও হচ্ছে। আমরাও সব জায়গায় চাহিদা অনুযায়ী সার সরবরাহ করছি।"
কৃষি মন্ত্রণালয়, বিসিআইসি ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, অনেক ডিলার আছেন, যারা টাকা জমা দিয়েও সার তুলছেন না। সংশ্লিষ্টরা জানান, যেখানেই এ ধরনের সংকটের কথা তারা জানছেন, সেখানেই জেলা প্রশাসকদের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। কিন্তু সংকট এমনভাবে সারাদেশে ছড়িয়েছে যে, এটি সহজে সমাধান করা যাচ্ছে না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ শাখার অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, "জামালপুরের সংকটটা পুরোপুরি ডিলারদের জন্যই হয়েছে। তাদেরকে আশুগঞ্জ থেকে সার তুলতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তারা সেটি করেনি। গ্যাসের অভাবে যমুনা বন্ধ থাকায় সেখানে উৎপাদন কম। বরগুনা, বরিশালেও একই ধরনের সমস্যা হয়েছে। কিন্তু এগুলো আমরা এখন সমাধান করেছি।"
তিনি বলেন, "আমাদের সারের কোনো ঘাটতি নেই। যেসব ডিলার ঝামেলা করছে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কারও কারও লাইসেন্সও বাতিল করা হচ্ছে।"
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, "সামনে নির্বাচন, এই ইস্যুকেও সামনে এনে কেউ কেউ অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে।"
এদিকে গত বুধবার সারাদেশের জেলাক প্রশাসকদের সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব একটি মিটিং করেন। এই সভায় কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম কারসাজি রোধে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন।
রশিদ ছাড়া সার বিক্রি বন্ধ, মূল্যতালিকা টাঙানো, খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সার সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিলারের গুদাম পরিদর্শন করে সারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বলা হয় সভায়।
সেইসঙ্গে, জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগাযোগ করে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া, কৃষি মন্ত্রণালয় হতে সার বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গেই বিসিআইসি'র হতে সার উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার জন্য বিসিআইসি চেয়ারম্যানকে পরামর্শ প্রদান করা হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বর্তমানে ইউরিয়া সারের মজুদ ৬ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন, টিএসপি ৪ লাখ ১৫ হাজার টন, ডিএপি ৯ লাখ ০৪ হাজার টন, এমওপি ২ লাখ ৪৬ হাজার টন রয়েছে।
সারের বর্তমান মজুদের বিপরীতে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সারের চাহিদা হলো- ইউরিয়া ৩ লাখ ৫০ হাজার টন, টিএসপি ৯৬ হাজার টন, ডিএপি ২ লাখ ১৯ হাজার টন, এমওপি ১ লাখ ২১ হাজার টন।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশন (বিএফএ) এর সভাপতি কামরুল আশরাফ খান পোটন টিবিএসকে বলেন, "সারাদেশেই কিছু কিছু সমস্যা হয়েছে এবং হচ্ছে এটি সত্য। সরকারের সঙ্গে আমরাও চেষ্টা করছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য। সারাদেশে সরকারের পাশাপাশি আমরাও মনিটরিং করছি।"