বিদেশি উৎস থেকে এক হাজার কোটি টাকা তহবিল সংগ্রহ করতে চায় আর্থিকভাবে সংকটাপন্ন ন্যাশনাল ব্যাংক
দুই বছর ধরে তীব্র আর্থিক সংকটে ভোগা বেসরকারি বাণিজ্যিক ন্যাশনাল ব্যাংক রেগুলেটরি ক্যাপিটালের শর্ত পূরণে এখন বিদেশি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বৈদেশিক উৎস থেকে এক হাজার কোটি টাকা তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বৈদেশিক মুদ্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সাত বছর মেয়াদী বন্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রথম বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার বন্ড ইস্যু করতে যাচ্ছে।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহমুদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ব্যাংকের মূলধন ক্ষয়কারী উচ্চ নন-পারফর্মিং ঋণের কারণে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে।
মেহমুদ হোসেন জানান, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। বিদেশি তহবিল শুধু ব্যাংক নয় দেশের জন্যও ভালো হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বৈদেশিক মুদ্রার বন্ড অনুমোদন করেছে কারণ আমরা উচ্চ নন-পারফর্মিং ঋণ এবং বর্তমান আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অবহিত করার পরেও তাদের কাছ থেকে প্রাথমিক আশ্বাস পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পেছনে মূল কারণ ব্যাংকের সম্পদের ভিত্তি বেশ শক্তিশালী।
কর্পোরেট ঋণ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে এসএমই খাতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ব্যাংকের ব্যবসায়িক কৌশলকে তিনি নতুনভাবে সাজাতে চান বলে জানান।
এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকটি দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে তহবিল বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলধন জোরদার করার পরিকল্পনা করছে।
এর আগে মে মাসে ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রক মূলধনের শর্তপূরণে সাব-অর্ডিনেট বন্ড ইস্যু করে দেশীয় উৎস থেকে ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের ঘোষণা করে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের রিস্ক ওয়েটেড ক্রেডিট এক্সপোজার সম্পর্কিত ক্যাপিটাল অ্যাডিকেসি রেশিও (সিএআর) জুন মাসে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশে এসে দাঁড়ায়, যা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শর্ত অনুযায়ী ন্যূনতম ১০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
বিপুল ঋণ অসঙ্গতির কারণে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ব্যাংকের মূলধন সংকুচিত করে।
জুন মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
উচ্চ খেলাপি ঋণের ফলে জুন মাসে ব্যাংকটি ৭,১১৫ কোটি টাকার বিশাল প্রভিশন ঘাটতিতেও পড়ে।
প্রভিশন হল ভব্যিষতের ক্ষতিপূরণের জন্য ব্যাংকের আলাদা করে রাখা তহবিল। উচ্চ খেলাপি ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোর আরও উচ্চতর প্রভিশনিং বজায় রাখতে হয়, যা মুনাফা থেকে সংগৃহীত হয়।
ক্রমবর্ধমান প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকগুলোর মূলধন ক্ষয় করে যা ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা সংকুচিত করে, যার ফল জনসাধারণের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়া।
ক্রমবর্ধমান প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ক্ষয়ের চাপের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ছয়মাসে ব্যাংকটি ১৯০ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগের পরও গত দুই বছর ধরে ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
আর্থিক সূচকের অবনতির কারণে ডিএসইতে ব্যাংকটির শেয়ার মূল্য গত দুই বছর ধরে ১০ টাকার ফেস মূল্যের নিচে অবস্থান করছে।
নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ১০টি দুর্বল ব্যাংকের একটি হিসেবে ব্যাংকটিকে চিহ্নিত করে।
গভর্নর সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করার বিষয়ে বলেন, ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সঙ্গে এক-এক করে বসবে।
ব্যাংকগুলোকে তাদের মূলধনের ঘাটতি, খেলাপি ঋণের হার, প্রভিশনিং এবং ঋণ-আমানত অনুপাতের ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
গভর্নর এরই মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক পারফরম্যান্স নিয়ে মালিক ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ব্যাংকটিতে প্রশাসক নিয়োগের পরিকল্পনা করছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে।
বিপুল ঋণ অনিয়মের কারণে সৃষ্ট তারল্য সংকটের প্রেক্ষাপটে গত বছরের মে মাসে ব্যাংকটির ঋণ কার্যক্রম স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পরবর্তীতে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হলে ডিসেম্বরে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
কিন্তু দীর্ঘ স্থগিতাদেশের পরেও ব্যাংকে ঋণ সংক্রান্ত অনিয়ম অব্যাহত থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছরের মে মাসে আবারও স্থগিতাদেশে যেতে বাধ্য হয়। তবে এবার আংশিক স্থগিতাদেশ দেওয়ার মাধ্যমে ঋণ খাত সীমিত রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক।