আমন উৎপাদনে বাড়তি খরচ, চাপ থাকবে চালের দামে
একদিকে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা, অন্যদিকে সেচের বাড়তি খরচ, সারের দাম, শ্রমিকের বাড়তি মজুরির কারণে এবারে আমনের উৎপাদন খরচ ৩৯ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে সরকারি একটি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে। এই অবস্থায় আমন মৌসুমের ফলন উঠলেও চড়া দামেই ভোক্তাকে চাল খেতে হতে পারে বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ২০২১ সালের হিসাব থেকে জানা যায়, গত আমন মৌসুমে এক কেজি আমন ধান উৎপাদন করতে ২৫ টাকা খরচ হয়েছে কৃষকের।
বগুড়া সদরের যশোপাড়ার কৃষক আবু আলম টিবিএসকে বলেন, 'বৃষ্টি কম হওয়ায় সেচ মেশিনেই এবার নির্ভর করতে হচ্ছে। আড়াই বিঘাতে এবার ধান লাগিয়েছি। বিদ্যুৎচালিত সেচে এলাকায় প্রতি শতকে নেয়া হচ্ছে ৪০ টাকা। আর ডিজেলচালিত সেচে এই খরচ পড়ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।'
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) তথ্য বলছে, এবারে সারাদেশে প্রায় ৫ লাখ সেচ মেশিন দিয়ে জমিতে পানি দিতে হচ্ছে।
জামালপুরের আরেক কৃষক মো. মতিউর জানান, 'এবারে বিঘাপ্রতি ৮০০ টাকা হিসেবে পুরো মৌসুমের সেচের খরচ দিতে হবে। বাজারে ইউরিয়ার দাম সরকার প্রতি বস্তা ১১০০ টাকা নির্ধারণ করলেও আমরা কিনছি ১৩০০ টাকা দিয়ে। তাও পাওয়া যাচ্ছে না।'
মতিউর, আবু আলমের মত অবস্থা এখন সারাদেশের কৃষকদের। সরকারি একটি সংস্থা আমনের উৎপাদন খরচের একটি গবেষণা করে দেখেছে, একর প্রতি আমন উৎপাদনে আগের বছরগুলোতে যেখানে ১৮-২০ হাজার টাকা খরচ হতো এবার সেখানে খরচ গিয়ে দাঁড়াবে ২৫-২৮ হাজার টাকা।
একর প্রতি সেচের মূল্য ১৭০০-১৮০০ টাকা থেকে বেড়ে এবারে ২৫০০ টাকায় উঠেছে। অর্থাৎ হিসাব করলে দেখা যায়, সেচেই খরচ বৃদ্ধির হার ৩৮-৪০ শতাংশ। অধিকাংশ জেলাতেই ইউরিয়া সারের সংকট, দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে এমওপি। জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ের কৃষকরা ইউরিয়া সার পাচ্ছেন না। যারা পাচ্ছেন তাদেরকেও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। সারাদেশে এই সময়ে গড়ে শ্রমিকের মূল্য বেড়েছে ১৫-২০%। সবমিলে এবারে আমনের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে গড়ে ৩৯ শতাংশ।
ব্রি'র মহাপরিচালক ড. মোঃ শাহজাহান কবীর টিবিএসকে বলেন, 'গত বছর এক কেজি আমন উৎপাদনে খরচ হয়েছে ২৫ টাকা। এবারে কোন কোন জায়গায় কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সারের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে, কোথাও কোথাও সেচ দিতে হচ্ছে, শ্রমিকের খরচ বেশি। এসব কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আমরা এগুলো হিসাব করছি, মৌসুম শেষে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে কতটা খরচ বাড়লো।'
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে আমনের উৎপাদন উঠলেও ধানের দাম থাকবে বেশি। গত বছর আমন মৌসুমে ১.৪৯ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছিল। এবারে লক্ষ্যমাত্রা এর চেয়ে বেশি থাকলেও মানুষ পানির সংকটে আমন ধান কম লাগিয়েছে। আমন লাগানোর সবচেয়ে উপযোগী সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয় জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের ১৫ তারিখ পর্যন্ত। তবে এবারে আগস্টের শেষ দিকেও কিছু কিছু ধান রোপণের খবর পাওয়া গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১.৫৯ লাখ হেক্টর জমির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৭০ শতাংশ জমিতে ধান রোপণ হয়েছে। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ জমিতে এবারে ধান লাগানোই হয়নি।
একদিকে উৎপাদন ঘাটতির শঙ্কা, অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি। দুয়ে মিলে বাজারে চালের দাম খুব বেশি কমে যাওয়ার সুযোগ কম।
বর্তমানে খুচরা বাজারে ২/১ টাকা দাম কমলেও চালের দাম এখনো রেকর্ড পরিমাণ। বাজারে মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৫৫ টাকা বা তারও বেশি দিয়ে। চিকন চাল কিনতে খরচ হচ্ছে ৭৫ টাকার বেশি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, আমনে সারাদেশে ৬১ শতাংশ কৃষক নির্ভর করে বৃষ্টির পানির উপর। যেখানে বৃষ্টিপাত কম হলে বা না হলে আবাদ ব্যাহত হবে এবং এর ফলে ফলন কমে যাবে। এমনিতেই আমন মৌসুমে উৎপাদন কম হয়। বোরো মৌসুমে এক বিঘা জমিতে যেখানে গড়ে ২৬-২৬ মণ ধান হয় সেখানে আমনে পাওয়া যায় ৮-১২ মণ।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত জুলাইতে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ৪৯৬ মিলিমিটার, যেখানে হয়েছে ২১০ মিলিমিটার। যা চাহিদার তুলনায় ৫৭.৫৬ শতাংশ কম। এটি ছিল ৪২ বছরের মধ্যে রেকর্ড সর্বনিম্ন। অন্যদিকে আগস্টে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ৪০২ মিলিমিটার, যেখানে ২৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় ৩৬.৪৭ শতাংশ কম।
চলতি সপ্তাহে অবশ্য দুই-তিনদিন ধরে সারাদেশে মাঝারি-ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এর ফলে কৃষকের মধ্যে কিছুটা স্বস্তিও ফিরেছে। তবে এই বৃষ্টিও পর্যাপ্ত নয় বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে কৃষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমন উৎপাদনে খরচ বাড়ছে, এর একটা প্রভাব চালের দামে আসবে। যৌক্তিক দামে যদি কৃষক আমন বিক্রি করতে পারে তবে চালের দাম বেশিই থাকবে, খুব একটা কমবে না। আবার কৃষক যদি দাম না পায় তবে এর প্রভাব যাবে বোরোর আবাদে। কারণ অনেক কৃষকই আমন ধান বিক্রি করে সে টাকা বোরো মৌসুমের ধান চাষে খরচ করে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, 'সরকার সারের যে দাম বাড়িয়েছে তার চেয়েও বেশি দাম দিয়ে কৃষক সার কিনছে। বৃষ্টিনির্ভর আমনে এবার রীতিমত সেচ দিতে হচ্ছে। এখানেও পুরো খরচটাই বাড়তি। সবমিলিয়ে হয়তো ৪০ শতাংশের বেশি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এই খরচ তো ধান বিক্রি করে কৃষককে তুলতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে নতুন ধান আসলেও চালের দাম খুব একটা কমার সুযোগ নেই। এই অবস্থায় বাজারটা স্থিতিশীল রাখতে সরকারকে আমদানি করে হলেও সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে।'
তিনি বলেন, 'এই খরচ কমিয়ে আনার জন্য ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়ার বিকল্প নেই।'
কৃষিমন্ত্রী ড. মো আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ডিজেলে ভর্তুকির দেওয়ার ভাবনার কথা জানিয়েছেন।