কোরিয়ার আরএমজি বাজার হাতছানি দিচ্ছে
রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণ করতে চাইছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেশের পোশাক খাতের লক্ষ্য এখন দক্ষিণ কোরিয়ার সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক বাজারের একাংশ ধরা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার পোশাক বাজারের মোট চাহিদার ৩৪ শতাংশ মেটায় চীন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কারণে চীনের পোশাক উৎপাদন কমছে। ফলে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের সামনে এখন কোরিয়ার বাজার ধরার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) জানিয়েছে, অন্তর্বাস, ডেনিম, শার্ট, জ্যাকেট ও পুলওভারের মতো বৈচিত্র্যময় আইটেমে ভর করে কোরিয়ায় পোশাক খাতের রপ্তানি চলতি অর্থবছরে ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করছে তারা।
অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক দামে পোশাক সরবরাহ করতে পারে বলে বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং বাড়াতে আগ্রহী হয়ে উঠছে কোরিয়ান ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোও।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০১৭ সাল থেকে কোরিয়ার পোশাক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ক্রমেই বাড়ছে। যদিও সে গতি বেশ ধীর। দেশটির পোশাক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা ৪ শতাংশের কিছু বেশিতে পৌঁছেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কোরিয়ার পোশাক বাজার থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ৪৪০ মিলিয়ন ডলার।
মহামারিজনিত শ্লথগতি সত্ত্বেও কোরিয়ান বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের চালান গত টানা পাঁচ বছর ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। শিল্পমালিকরা মনে করেন, দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা বাড়াতে একটা বড় ধাক্কা প্রয়োজন। আর সেই ধাক্কার কাজটি করবে চীন, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বাংলাদেশে আসা কার্যাদেশগুলো।
ইপিবির তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে পোশাকের চালান প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। এ সময় দেশটিতে ৯৮.৮৬ মিলিয়ন ডলারের পোশাকের চালান গেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৫৮.২৮ মিলিয়ন ডলারের পোশাকের চালান গিয়েছিল দেশটিতে।
কোরিয়ান রিটেইলার শিনসুং তংসান চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে ঢাকায় একটি সোর্সিং অফিস খুলবে বলে জানিয়েছেন প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে অবগত ঢাকার একটি বায়িং হাউসের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রধান। উল্লেখ্য, শিনসুং তংসান তিনটি ব্র্যান্ডের মালিক—টপটেন, পুলহ্যাম ও জিওজিয়া। এর মধ্যে টপটেনের বার্ষিক বিক্রি ৪৩০ মিলিয়ন ডলার।
শিনসুং তংসান মূলত আন্ডারওয়্যার, ডেনিম ও শার্ট আমদানি করে। তবে সম্প্রতি রিটেইলারটি এসবের পাশাপাশি নিটওয়্যার আইটেমও সোর্সিং শুরু করেছে বলে জানান ওই বায়িং হাউসের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রধান।
এছাড়া সিউলভিত্তিক বৃহত্তম ই-কমার্স কোম্পানি কুপাং—যা কিনা কোরিয়ান আমাজন নামেও পরিচিত—বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি শুরু করেছে।
নতুন ক্রেতা খুঁজে বের করতে ও বিনিয়োগ আনতে আরএমজি মালিক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) প্রতিনিধিরা আগামী ২২ অক্টোবর কোরিয়ায় সাত দিনের সফরে যাবেন।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'আমরা কোরিয়ার বড় ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোকে আমাদের কাছ থেকে পণ্য সোর্স করতে আমন্ত্রণ জানাব। আমরা তাদের ম্যানমেইড ফাইবারের পণ্য তৈরিতে যৌথ সহযোগিতার প্রস্তাবও দেব।'
ফারুক জানান, বিজিএমইএ তাদের নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য রপ্তানি বাজার চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—কোরিয়া, জাপান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা। ফারুক আরও জানান, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি ফার্মকে তাদের পণ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যবসার সুযোগ ও আন্তর্জাতিক বাজার খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছেন।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, ল্যাটিন আমেরিকায়ও একই রকমের একটি বাণিজ্য মিশন নেওয়া হয়েছিল। ওই অঞ্চলে ১০ বছর আগেও বাংলাদেশ বছরে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করত। ওই বাণিজ্য মিশনের সুবাদে ল্যাটিন আমেরিকায় এখন বাংলাদেশ এখন ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাক রপ্তানি করে।
শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, 'আশা করছি আমাদের আগামী মাসের কোরিয়ান মিশন ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটিতে আমাদের পোশাক রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।'
কোরিয়ায় হাই-ভ্যালু শীতের কাপড় ও ডেনিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মূলত এসব পোশাকের ওপর ভর করেই তারা দেশটিতে ৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির মাইলফলকে পৌঁছবেন বলে জানান বিজিএমইএর সহসভাপতি।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ভালো চাহিদা আছে এমন অন্যান্য সম্ভাব্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে নন-লেদার ফুটওয়্যার, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি।
বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লি জ্যাং-কেউন সম্প্রতি টিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য তৈরি পোশাকের বাইরেও আর কোন কোন খাতকে বেছে নেওয়া যায়, তা খতিয়ে দেখছে দক্ষিণ কোরিয়া।
তিনি বলেন, 'ভবিষ্যতে আমরা আরএমজির বাইরেও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবছি। আমরা চাই অন্যান্যা খাতের কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করুক।'
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়া ২০২১ সালে ১০.৫৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি ৩.৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে চীন। এরপরেই ভিয়েতনাম, ইতালি ও ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান।
অন্যদিকে ইপিবির তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে কোরিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৩০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৪০ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ২০২টি দেশে পণ্য রপ্তানি করে। এর মধ্যে কোরিয়া বাংলাদেশের ২০তম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য।
বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের পথিকৃৎ দেশ গার্মেন্টস আধুনিক যন্ত্রপাতি চালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত পোশাক প্রস্তুতকারক কারখানা দায়েউ-তে ১৩৩ জন কর্মী ও মধ্যম-পর্যায়ের ব্যবস্থাপককে পাঠায়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে দলটি দেশে ফেরে। ওই কর্মীদের নিয়ে দেশ গার্মেন্টস একটি নতুন কারখানা স্থাপন করে। সেই কারখানাটি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করার নবযাত্রার সূচনা করে।
অক্টোবরের কোরিয়া সফরটি নতুন রপ্তানি বাজার খুঁজে বের করার জন্য বেসরকারি খাত ও সরকারি সংস্থাগুলোর শুরু করা একক দেশকেন্দ্রিক অভিযানের অংশ। সৌদি আরবের ১৫২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বাজারের একাংশ ধরার জন্য রপ্তানিকারকদের তাদের পণ্য প্রদর্শনে সহায়তা করতে রপ্তানি উন্নয়ন সংস্থা রিয়াদে ৬ থেকে ৮ অক্টোবর একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মেলার আয়োজন করবে। সৌদি আরব বছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের খাদ্য ও পানীয়, পোশাক, পাট ও চামড়া আমদানি করে। দেশটিতে এসব পণ্য রপ্তানি করে আয় করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত গন্তব্যের বাইরে সম্ভাব্য বাজার খুঁজতে চীন ও জাপানে রপ্তানি মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে পোশাক খাতের সংস্থা বিজিএমইএ।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ২০২৪ সালে ৮০ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৬ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে কাজ করছে সরকার।
দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। পাশাপাশি আইসিটি, লেদার, প্লাস্টিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, পাটসহ প্রায় ১০টি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকার এশীয় বাজার খুঁজছে।