জাপানে পোশাক রপ্তানি ২০০ কোটি ডলার হওয়ার পথে, এখন টার্গেট আরও বড়
রপ্তানি বৃদ্ধির সুবাদে উচ্চ মানের পণ্য দিয়ে জাপানের ২৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক বাজারের আরও বড় অংশ দখল করতে চান বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, করোনা মহামারির অভিঘাতে টানা দুই বছর গতি হারানোর পর, ২০২১-২২ অর্থবছরে ফের জাপানে পোশাক রপ্তানি ১০০ কোটি ডলারের ঘর পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, স্পোর্টসওয়্যার, ডেনিম ও অন্তর্বাস চালানের সুবাদে, চলতি অর্থবছরে জাপানে রপ্তানি ২০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহৎ জাপানি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে তারা সন্তোষজনক সংখ্যায় কার্যাদেশ পাচ্ছেন। অনেক ব্র্যান্ড ও বায়ার– বাংলাদেশের কৃত্রিম তন্তু (ম্যানমেইড ফাইবার) উৎপাদন শিল্পেও বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বর্তমানে উন্নত দেশগুলো চীন নির্ভরশীলতা কাটাতে 'চায়না-প্লাস-ওয়ান' কৌশল অবলম্বন বাড়ছে। এর মাধ্যমে শুধু চীনে বিনিয়োগ না করে– এখাতের কোম্পানিগুলো অন্য দেশেও বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের পণ্য সংগ্রহের উৎসে বৈচিত্র্য আনছে বলে জানান তারা।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার (আইটিসি)'র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে জাপানের পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বাড়ছে এবং ২০২১ সালে যা প্রায় ৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
শিল্প মালিকরা বলছেন, তারা এখন চীন, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তরিত আদেশকে পুঁজি করে জাপানের বাজারে নতুন বায়ার সন্ধান করছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন– ২০১০ সালেই নতুন গতি পায় জাপানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি। ওই সময় দেশটি চীন-প্লাস-ওয়ান কৌশলের অধীনে বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে। 'এখন অনেক জাপানি অর্ডার মিয়ানমার, চীন এবং ভিয়েতনাম থেকে আমাদের কাছে স্থানান্তরিত হচ্ছে'- বলছিলেন তিনি।
ইপিবি'র তথ্যানুসারে, জাপানের বাজারে পোশাকের চালান চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রায় ২৬% বেড়ে ২১৭ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে; যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৭২.৯১ মিলিয়ন ডলার।
জাপানি ফ্যাশন কোম্পানি 'ফাস্ট রিটেইলিং' — ইউনিক্লো-সহ ছয়টি পোশাক ব্র্যান্ডের মালিকানা প্রতিষ্ঠান। মার্কিন ব্যবসায়িক ম্যাগাজিন ফোর্বস জানায়, ২০২২ সালে কোম্পানিটি ১৯.৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
কোম্পানির ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০২১ সালের জাপানি পঞ্জিকাবর্ষে ইউনিক্লো'র আয় হয় ১২.৩ বিলিয়ন ডলার।
দুর্বল জাপানি ইয়েনের সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়ে ইউনিক্লো'র। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণে চীনে বিক্রিবাট্টা কম হওয়ার ঘাটতিও পুষিয়ে যায় অনেকটাই। ফলে রেকর্ড ত্রৈমাসিক মুনাফা হওয়ার তথ্যও জানায়।
কোম্পানিটি একটি আর্থিক বিবৃতিতে বলেছে, মে মাসের শেষপর্যন্ত তিন মাসে পরিচালন মুনাফা এক বছর আগের থেকে ৩৭ শতাংশ উল্লম্ফন করে হয়েছে ৮১.৮ বিলিয়ন ইয়েন বা ৫৮৭.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ।
এনভয় টেক্সটাইল লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাপানি ক্রেতারা (বায়াররা) মানের ব্যাপারে খুবই সতর্ক। এজন্য তারা আগে পণ্যের মান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারপর সময় নিয়ে অর্ডার দেয়।
ইউনিক্লোর একজন সরবরাহকারী কুতুবুদ্দিন বলেন, 'আমাদের অনেক জাপানি বায়ারের সাথে ব্যবসা আছে। তাদের ব্যবসার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১০-১২ শতাংশ'।
এই বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এনভয় টেক্সটাইলের প্রতিষ্ঠাতার মতোন করেই, ঊর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে দুটি জাপানি পোশাক ব্র্যান্ড– জিইউ এবং মুজি'র সাথে ব্যবসা করছি'।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামাল কামরুজ্জামান জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান জাপানের বাজারে কিছু খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি করে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত– চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার জাপান।
অস্তান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল ওয়ারা টিবিএসকে বলেন, জাপানে বাংলাদেশের চামড়া, চামড়ার ব্যাগ এবং পাদুকা রপ্তানি প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
তবে জাপানে এখনও চামড়ার ব্যাগ এবং জুতোর প্রধান সরবরাহকারী চীন। এক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার পরও, চীন একটি পূর্ণাঙ্গ সরবরাহ চেইনের সুবিধা পায়– যা চালানের লিড টাইমের ক্ষেত্রে দেশটিকে বাড়তি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দেয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ইবনুল ওয়ারা আরও বলেন, ভৌগলিক দিক থেকেও চীনের কাছাকাছি জাপান। এই নৈকট্য লিড টাইম কম হওয়ার সুবিধা দেয়। ফলে ক্রেতাদের আগেভাগে বেশি বেশি অর্ডার করতে হয় না।
একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ সরবরাহ শৃঙ্খল থাকলে- তাতে উপকৃত হবে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য খাত। এতে চামড়া ছাড়া পণ্য উৎপাদনে দরকারি অন্যান্য উপাদান আমদানির নির্ভরশীলতা কমবে।
পাদুকা এবং ব্যাগের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা গেলে-তা বাংলাদেশের লিড টাইম ৩০ দিন পর্যন্ত কমাতে সাহায্য করবে– যোগ করেন তিনি।
নতুন ক্রেতা খুঁজতে বিজিএমইএ চলতি বছরের নভেম্বরে জাপানে একটি ট্রেড শোতে যোগ দেবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএসকে বলেন, 'জাপান আমাদের জন্য একটি বড় রপ্তানি গন্তব্য। চলতি অর্থবছরে দেশটি থেকে আয় দ্বিগুণ করতে চাই আমরা'।
'মহামারির কারণে দুই বছর বন্ধের পর– আমরা এখন সেদেশে যাব এবং বৃহৎ জাপানি বায়ার ও ব্র্যান্ডগুলিকে আমাদের থেকে পণ্য সংগ্রহের প্রস্তাব দেব'।
ফারুক আরও বলেন, বিজিএমইএ তাদের নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য রপ্তানি বাজার চিহ্নিত করেছে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– কোরিয়া, জাপান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা।
নিজস্ব পণ্যের সম্ভাবনাময় বাজার অধ্যয়ন ও চিহ্নিত করতে বিজিএমইএ আন্তর্জাতিকভাবে নামজাদা একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করেছে বলেও জানান তিনি।
শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, 'আমরা আশা করি, ২০৩০ সালের মধ্যে জাপানে আমাদের পোশাক রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে'।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার (আইটিসি)'র তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে জাপানের পোশাক আমদানি ছিল ২৩.৮৩ বিলিয়ন ডলার। ১৩.৯০ বিলিয়ন ডলার অংশ নিয়ে রপ্তানিতে শীর্ষে ছিল চীন, ৩.৪৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে দ্বিতীয় স্থানটি ছিল ভিয়েতনামের।