আমাদের জন্যও ডলারের দর ১০৮ টাকা নির্ধারণ করা হোক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্দেশ্যে রপ্তানিকারকরা
রপ্তানি আয় নগদায়নের ক্ষেত্রে ডলারের দর সংশোধন করে ১০৮ টাকা নির্ধারণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন টেক্সটাইল মিল মালিকরা। রেমিট্যান্স আয়ের মতো– এই ক্ষেত্রেও সমান দর সুবিধা পেলে, তারা বিভিন্ন প্রকার বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্যে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবেন বলে আশা করছেন।
তাদের আশঙ্কা, 'বৈষম্যপূর্ণ বিনিময় দর' সমান্তরাল করা না হলে– তাতে করে, ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পোশাক রপ্তানিতে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প হিসেবে— ২৯ বিলিয়ন ডলার অবদান রাখা পুঁজিঘন টেক্সটাইল শিল্প অল্প-সময়ের মধ্যেই রুগ্ন হয়ে পড়বে। এর প্রভাবে কর্মসংস্থান হারাবে লাখ লাখ কর্মী এবং এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়বে পোশাক রপ্তানির ওপরও।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)'র সূত্রগুলি জানিয়েছে, টেক্সটাইল খাতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখানে বিনিয়োগ রয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
টেক্সটাইল মিল মালিকরা বলছেন, প্রথমে কোভিড-১৯ মহামারি এবং তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জ্বালানি ও কাঁচামাল, পরিবহন ভাড়া ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ায় তারা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়েছেন। তার সাথে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটেও কমেছে উৎপাদন। এতে করে তাদের সার্বিক ব্যয় অনেক বেড়েছে।
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে একটি চিঠি দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, 'আমদানি বিল পরিশোধ এবং রপ্তানি আয় নগদায়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কিন ডলারের ভিন্ন দর নির্ধারণ করার ফলে আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হবে'।
দেশের রপ্তানিকারকদের অর্জিত আয়ের ওপর ডলারের বিনিময় দর– ৯৯ টাকা নির্ধারণের বিষয়টি উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোতে ডলারের দর অনেক বেশি। যেমন পাকিস্তানের রপ্তানিকারকরা প্রতি ১ ডলার রপ্তানি আয়ের বিপরীতে ২৬০ রুপি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রতিযোগী দেশের টেক্সটাইল মিলারদের আরেকটি সুবিধা রয়েছে – তারা স্থানীয় উৎস থেকেও কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে এখাতের উদ্যোক্তাদের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের সংক্ষিপ্ত লিডটাইম ধরে রাখতে উচ্চ মূল্যে হলেও কাঁচামাল আমদানি করতে হয়।
টেক্সটাইল মিলারদের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি- বিকেএমইএ'র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের বক্তব্যেও। তিনি বলেন, সবার জন্য সুষম হওয়া চাই ডলারের দর। ডলার কেনা ও বেচার ক্ষেত্রে পার্থক্য কোনোভাবেই এক টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বিপুল সংখ্যক রপ্তানিকারক রপ্তানি আয়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক-নির্ধারিত ডলারের বিনিময় হারও পাওয়ার যোগ্য নয়– কারণ তারা নগদ প্রবাহ বজায় রাখার জন্য তাদের রপ্তানির নথি আগেই কম দরে বিক্রিতে বাধ্য হন।
হাতেম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দর সংশোধন না করলে চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ আমার কোম্পানি ঠিক এই কারণে ১০ কোটি টাকা ঘাটতির মধ্যে পড়বে'।
একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ডলারের ভিন্ন ভিন্ন দর রপ্তানিকারকদের জন্য বৈষম্যমূলক; কারণ বেশিরভাগ বৈদেশিক মুদ্রা তাদের মাধ্যমেই দেশে আসে।
'আমরা ডলার ব্যবসার একটি উন্মুক্ত বাজার চাই। দর নির্ধারণ ভালো আইডিয়া হতে পারে না। এভাবে ডলারের দর নির্ধারণ করলে তাতে হিতে-বিপরীত হতে পারে'।
পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী নেতারা আশঙ্কা করছেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিশ্ববাণিজ্যের প্রধান প্রধান মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলার শক্তিশালী হওয়ার ঘটনা- গ্রাহকদের ক্রয় ক্ষমতা কমাচ্ছে।
ফলস্বরূপ, পোশাক রপ্তানিকারকরা গত দুই মাসে তাদের উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ কম অর্ডার পেয়েছেন বলে শিল্পের অভ্যন্তরীণরা জানিয়েছেন।
চাহিদা ও অর্ডার কমছে
পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে বিশ্বের সকল অর্থনীতিতে। দেশের পোশাক খাতের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলিও নয় তার বাইরে। এতে করে, পশ্চিমা ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে। পাশাপাশি শক্তিশালী ডলারও কমাচ্ছে অমার্কিন ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা।
তারা জানান, গত দুই মাসে পশ্চিমা দেশ থেকে তাদের উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে ২০ শতাংশ কম অর্ডার এসেছে।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, সোমবার ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং মুদ্রার বিনিময় দরে নেমেছে সর্বকালের সবচেয়ে বড় ধস। পরিস্থিতি সামাল দিতে অচিরেই ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ব্যবস্থা নিবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই কার্যদিবসের লেনদেনের এক পর্যায়ে প্রায় ৫ শতাংশের মতো দর পড়ে যায় পাউন্ডের, যা ১৯৮৫ সালের রেকর্ড পতনকেও ছাড়িয়ে যায়। একইসময় ইউরোর দর কমেছে ১ শতাংশ; অস্ট্রেলিয়ান ও নিউজিল্যান্ডের ডলার এবং ইউয়ান কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দরে নেমেছে।
বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নিট পোশাক রপ্তানি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে, তাই ইউরোপে অর্থনীতি গতি হারালে তার মারাত্মক প্রভাব আসবে রপ্তানির চিত্রে।
এনভয় টেক্সটাইলের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুদ্দিন আহমেদও বলেছেন, যখন ডলার শক্তিশালী হয়– তখন অনেক পশ্চিমা দেশের ভোক্তাদের জন্য কেনাকাটা আরও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে।
টানা ১৩ মাস ধরে প্রবৃদ্ধির সুবাতাস উপভোগ করার পর তার উল্টোমুখী প্রবণতায় পড়েছে দেশের পোশাক রপ্তানি। চলতি সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৮ দিনে বছরওয়ারি হিসাবে ১২ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএ'র তথ্যমতে, এই ১৮ দিনে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১৭২ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা হয়েছিল ১৯৬ কোটি ডলারের।