ফরাসি ফ্যাশন কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা, বকেয়া আদায় নিয়ে উদ্বেগে রপ্তানিকারকরা
বুধবার ফ্রান্সের লিলের একটি আদালত দেশটির ফ্যাশন চেইন ক্যামাইউকে দেউলিয়া ঘোষণা পর শনিবারই প্রতিষ্ঠানটির সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ঋণগ্রস্ত ক্যামাইউর কাছ থেকে কীভাবে বকেয়া অর্থ আদায় করা যায়, তা নিয়ে এখন উদ্বেগে পড়েছেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা।
ফ্রান্সের এই খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে স্থগিতাদেশ দেওয়ার দুইমাস পর দেউলিয়া ঘোষণা করেন আদালত। সেই স্থগিতাদেশটি এখন জুডিশিয়াল লিকুইডেশনে রূপান্তরিত হয়েছে বলে উঠে এসেছে বেলজিয়ামের একটি ফরাসি-ভাষী নিউজ ওয়েবসাইট 'সেভেন সার সেভেন'-এ। ২৪০ মিলিয়ন ইউরোর ঋণের পাহাড় পরিশোধ করতে কোম্পানির সমস্ত সম্পদ আংশিকভাবে তরল (নগদ) করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এই ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনে।
এদিকে বিজিএমইএ সূত্র জানা যায়, বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ক্যামাইউর বার্ষিক ব্যবসা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের। সূত্রগুলো অবশ্য বলছে, ফরাসি এই ক্রেতার কাছে কতগুলো কোম্পানির কত টাকা আটকে আছে, সে বিষয়ে তাদের যথাযথ ধারণা নেই।
ফ্রান্সের বাজারের বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। সূত্র বলছে, দেশটির পোশাক বাজারের অন্যতম বড় ক্রেতা ক্যামাইউর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া, বাংলাদেশের সার্বিক পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে।
এই ধাক্কা এমন সময়েই আসলো, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সহ কয়েকটি প্রধান রপ্তানি গন্তব্যে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ইতোমধ্যেই কঠিন সময় পার করছে।
বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম ক্যামাইউর দেউলিয়া হয়ে যাওয়াকে 'অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়' বলে অভিহিত করে বলেন, বিজিএমইএ তার সমস্ত সদস্যদের নিজেদের বকেয়া পেমেন্টের বিষয়ের তথ্য দিতে বলবে।
তিনি বলেন, "আমরা পাওনা আদায়ের জন্য সম্ভাব্য সব উপায় কাজে লাগাবো।"
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন রিটেইল জেসিপেনি এবং সিয়ার্সসহ বেশ কয়েকটি ক্রেতা এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাশন রিটেইল চেইন পিককস এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চেইন দেবেনহামস সম্প্রতি দেউলিয়া হয়েছে। এতেও প্রায় ৫০০ ডলার ক্ষতির শিকার হয়েছেন বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা।
ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকরা আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি বিজনেস-টু-বিজনেস (বিটুবি) এবং গভর্নমেন্ট-টু-গভর্নমেন্ট (জিটুজি) আলোচনার মাধ্যমে বকেয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন বলে জানান তারা।
উইন্ডি গ্রুপের কাছে বকেয়া ৮.৪ মিলিয়ন ডলার
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানতে পেরেছে, উইন্ডি গ্রুপ নামে একটি পোশাক রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্যামাইউর প্রায় ৮.৪ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে।
জানতে চাইলে উইন্ডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ উদ্দিন খান টিবিএসকে বলেন, "কোম্পানি কীভাবে এমন করতে পারে, তা আমাদের ধারণায় নেই! আমাদের সঙ্গে ডিল করার সময় কোম্পানিটি তার ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলেছিল।"
তিনি আরও বলেন, ক্যামাইউ 'নতুন ব্যবসা' নিয়ে আলোচনার জন্য এই সোমবার তার কোম্পানির সঙ্গে একটি মিটিংও নির্ধারণ করেছিল।
"কিন্তু হঠাৎ করে কোম্পানির সোর্সিং বিভাগের একজন কর্মকর্তা একটি ই-মেইল পাঠিয়ে বলেন, ২৮ সেপ্টেম্বর একটি বাণিজ্যিক আদালত ক্যামাইউর সম্পদ জুডিশিয়াল লিকুইডেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের বক্তব্য, ক্যামাইউয়ের বর্তমান পরিকল্পনা এবং আর্থিক পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়," বলেন মেসবাহ।
ক্যামাইউ কর্মকর্তার ই-মেইল উদ্ধৃত করে তিনি আরও জানান, "আজ আমার কর্মক্ষেত্রে শেষ দিন। এই সিদ্ধান্তের জন্য আমি আপনার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কারণ আমি জানি এই সিদ্ধান্তটি আপনার কোম্পানিকে প্রভাবিত করবে।"
মেসবাহ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, ক্যামাইউ বন্ধ হওয়ায় তার কোম্পানি এক বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। কারণ তারা ইতোমধ্যেই ফরাসি ব্র্যান্ডের সঙ্গে ৮.৪ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি চুক্তির প্রায় অর্ধেক পণ্য তৈরি করে ফেলেছে এবং বাকি অর্ধেক পণ্য উত্পাদন পর্যায়ে রয়েছে।
"এটি আমার কোম্পানির জন্য একটি বড় অঙ্কের অর্থ, এই কাজে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার লোক নিয়োগ রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
উইন্ডি গ্রুপ ইতোমধ্যেই বিজিএমইএকে বাংলাদেশে ফ্রান্স দূতাবাস এবং ফ্রান্সে বাংলাদেশের দূতাবাসকে ক্যামাইউর কাছ থেকে পাওনা আদায়ের জন্য চিঠি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
কোভিডের প্রভাব
সফটেক্স সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজওয়ান সেলিম টিবিএসকে বলেন, একসময় ক্যামাইউর সঙ্গে তাদের ভালো ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল।
"কিন্তু কোভিডের সময় আমরা দেখেছি, প্রষ্ঠানটির ব্যবসায়িক ধারা স্বাভাবিক ছিলনা। পরে আমরা ক্যামাইউর সঙ্গে সমস্ত ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করি এবং আমাদের বকেয়া অর্থ আদায়ের জন্য একটি ঋণ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিকে নিয়োগ দেই। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই ফরাসি প্রতিষ্ঠানটি তাদের বকেয়া পরিশোধ করে," বিজিএমইএ'র সাবেক পরিচালক রেজওয়ান সেলিম টিবিএসকে এ কথা বলেন।
এক পৃষ্ঠার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা
২০২০ সালে ক্যামাইউ পুনরায় কার্যক্রম চালু করে, এবং এ সময় রিয়েল এস্টেট গ্রুপ লা ফিনান্সিয়ার ইমোবিলিয়ের বোর্ডেলাইজ (এফআইবি) কোম্পানিটিকে অধিগ্রহণ করে, অর্থাৎ এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তবে ইতোমধ্যেই কোভিড মহামারির ধাক্কায় দুর্বল হয়ে পড়া ফরাসি কোম্পানিটির অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।
এই অধিগ্রহণ নিয়েও ছিল তাৎক্ষণিক সন্দেহ।
ফ্রান্সের শিল্পমন্ত্রী রোল্যান্ড লেসকিউর এখন বলছেন, "অধিগ্রহণের পরিকল্পনাটি খুব ভালোভাবে বিবেচনা করা হয়নি, এটি ছিল এক পৃষ্ঠার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা। আমি রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় ৭০ মিলিয়নের বেশি প্রদান করার অবস্থানে নেই।"
কোম্পানির মালিক বলেছেন লিকুইডেশন এড়াতে সামনের ৮মাসে তার প্রতিষ্ঠানের ৭৯.২ মিলিয়ন ইউরোর প্রয়োজন। এই অর্থ দিয়ে শরৎ-শীতকালীন ব্যবসায়ের অর্থ প্রদান এবং অন্যান্য খরচসহ সামনের বসন্তের জন্য মালামাল কেনা হবে।
বুধবার সকালে মালিক পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ফরাসি সরকার কোম্পানিটিকে ৪৮ মিলিয়ন ইউরো অগ্রিম অর্থ প্রদান করবে, কারণ কোম্পানি এতে আরও বিনিয়োগ করতে চায়। এদিকে, দেশটির সরকার কোম্পানির এমন চাওয়াকে পুরোই অবাস্তব বলে মনে করছে।