পেমেন্ট পরিশোধে দেরী, বিপাকে পোলিশ প্রতিষ্ঠান এলপিপি-র ১০০ বাংলাদেশি সরবরাহকারী
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তৈরি পোশাক পণ্যের চালান ও পেমেন্ট পরিশোধ বিলম্বিত হওয়ায় ভোগান্তির সম্মুখীন মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এলপিপি'র সঙ্গে কাজ করা প্রায় ১০০ বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
এলসি চুক্তি অনুযায়ী ক্রেতারা ক্রয়াদেশের পণ্যগুলো নিয়ে না যাওয়ায় ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন বলে মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকরা। টিবিএসকে তারা জানান, পেমেন্ট না পাওয়ায় রপ্তানিকারক এবং কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তারল্য সংকটের সম্মুখীন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিন রপ্তানিকারক বলেন, তাদের ব্যাক টু ব্যাক এলসি ইতোমধ্যে 'ফোর্সড লোনে' রূপান্তরিত হয়েছে। এ অবস্থায় টিকে থাকতে বিষয়টি সমাধানে বিজিএমইএ-র হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
ইতোমধ্যে প্রস্তুতকৃত পণ্য ও স্থগিত হয়ে থাকা ক্রয়াদেশ মিলিয়ে পাওনার পরিমাণ প্রায় ১৮০ মিলিয়ন ডলার বলে জানান রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা ১৮টি কারখানার তথ্য পেয়েছেন যারা এলপিপির কাছে ৬০ মিলিয়ন ডলারের পেমেন্টের অপেক্ষা করছেন।
ব্র্যান্ডটির লিয়াজোঁ অফিস ও বায়িং অফিসের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ক্রেতারা রাশিয়া ও ইউক্রেনে তাদের প্রায় ৮০০টি দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন যার কারণে এসব দোকানের জন্য অর্ডার করা পণ্যগুলো বাংলাদেশে আটকে গেছে। তবে তারা অর্ডার করা সমস্ত পণ্য ধীরে ধীরে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পোশাক রপ্তানিকারকরা টিবিএসকে জানান, কোভিড-১৯ মহামারির সময় রপ্তানিকারকদের সুরক্ষার জন্য যে ধরনের সরকা্রি নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, এখন স্রেফ সেধরনের নীতিই পারে ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের এই সমস্যা থেকে বের করে আনতে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএসকে জানান, তিনি ইতোমধ্যে এলপিপি সরবরাহকারীদের সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি আরও জানান, প্রায় ১০ দিন আগে ব্র্যান্ডটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে তারা আগামী বছর জুনের মধ্যে ব্র্যান্ডের সমস্ত অর্ডারকৃত পণ্য সংগ্রহ ও সরবরাহকারীদের পাওনা অর্থ পরিশোধের পরিকল্পনার কথা জানায়।
এলপিপি-র ওয়েবসাইট অনুসারে, খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় আমদানি সহযোগী বাংলাদেশ। ব্র্যান্ডটির পোশাক পণ্যের চাহিদার ৭০ শতাংশই পূরণ করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে তারা সিরামিক, টেবিলওয়্যার ও পাটজাত পণ্যও আমদানি করে থাকে।
২০২১ সালে খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার ছিল ২.৮৪ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এলপিপির অন্যতম সরবরাহকারী লাইফ টেক্সটাইল ইতোমধ্যে এই খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির জন্য ২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক তৈরি করে এখন বিপাকে।
রূপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন গত মৌসুম থেকে তারা এলপিপির সঙ্গে বার্ষিক ৩ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করে।
প্রতিষ্ঠানটি এলপিপি ব্র্যান্ডের জন্য সোয়েটার ও টি-শার্ট তৈরি করেছে, যার মূল্য ৮ লাখ ডলার। এপ্রিল-জুলাইয়ের মধ্যে চালান পাঠানোর কথা থাকলেও এখন চালানের সময় পিছিয়ে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি নিয়ে যাওয়া হয়েছে।'
শহীদুল ইসলাম বলেন, 'ক্রেতার দাবি তাদের অসংখ্য দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা মালামাল নিয়ে বসে রয়েছে। কিন্তু ব্যাক টু ব্যাক এলসি পেমেন্টের কী হবে?
ব্যাংকগুলোর পেমেন্ট পরিশোধের সময় পার হয়ে গেলে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি পেমেন্টের পরিমাণকে বাধ্যতামূলক ঋণে রূপান্তর করে উল্লেখ করে তিনি করেন, 'এখন পর্যন্ত আমরা এটি স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হয়েছি, তবে বিশেষ এই পরিস্থিতির জন্য আমাদের সরকারি সহায়ক নীতি প্রয়োজন যেহেতু ক্রেতা কিছুদিন পর পেমেন্ট ক্লিয়ার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সমস্ত ব্যাংককে ইডিএফ তহবিল থেকে এই খুচরা বিক্রেতার পেমেন্ট সামঞ্জস্য করার নির্দেশ প্রদান, তা না হলে বেশিরভাগ সরবরাহকারীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে,' বলেছেন রূপা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
শহীদুল ইসলামের পুনরাবৃত্তি করে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, তারা এই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দেবেন এবং রপ্তানিকারকদের ফোর্সড ঋণ থেকে রক্ষা করতে কেস-টু-কেস ভিত্তিতে নীতি সহায়তা প্রদান করবেন।
বিজিএমইএ কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান তারা ইতোমধ্যে সদস্যদের এলপিপি সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য জানাতে বলেছে। সদস্যদের থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার পরে তারা ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের একটি তালিকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাবে।
দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এলপিপি কান্ট্রি ম্যানেজার
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হতেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশে এলপিপির কান্ট্রি ম্যানেজার।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সরবরাহ শৃঙখলে স্বচ্ছতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বাংলাদেশে এলপিপির কাজ শুরু করেন।
বাংলাদেশে অফিস খোলার পর, এলপিপি বড় প্রবৃদ্ধির মুখ দেখে এবং প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ থেকে সিরামিক, পাট এবং চামড়ার পণ্য আমদানি শুরু করে।
এলপিপি'র রাশিয়া ছেড়ে আসা
রয়টার্সের মতে, পোলিশ এই খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গত ১৯ মে তাদের রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান আরই ট্রেডিংকে একটি চীনা কনসোর্টিয়ামের কাছে বিক্রি করার ঘোষণা দেয়।
২০ বছর রাশিয়ায় ব্যবসা করার পর সেখান থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয় এলপিপি।
এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, 'অনিশ্চিত পরিস্থিতি এবং সশস্ত্র সংঘাতের ভবিষ্যৎ স্থির করতে না পারায়' তারা রাশিয়ায় নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কোম্পানির বিনিয়োগ সম্পর্ক বিষয়ক প্রতিনিধি ম্যাগডালেনা কোপাকজেউস্কা রয়টার্সকে বলেন, 'দ্বিতীয় আরেকটি রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান আরই ডেভলপমেন্টও বন্ধ করা হবে।'
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর মার্চ মাসে এলপিপি তাদের রাশিয়ান দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়।
প্রতিষ্ঠানটি এপ্রিলের মাঝামাঝি জানায় তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে চাইছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের ১৯ দশমিক ২ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে।