রপ্তানি আয় বাড়াতে নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছেন পোশাক প্রস্তুতকারকরা
২০৩০ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। এ লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে, আগামী বছরের মধ্যেই দেশের পোশাক ও বস্ত্র প্রস্তুতকারকরা নতুন প্রযুক্তিতে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন।
নতুন এই প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে পোশাক তৈরির অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতিসহ ম্যানমেড (মানবসৃষ্ট) ফাইবার এবং রোবোটিক প্রযুক্তি। এসব উন্নত প্রযুক্তি এই খাতের রপ্তানি পণ্যকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলার পাশাপাশি কারখানাগুলোর সামগ্রিক উৎপাদন বাড়াবে।
একইসঙ্গে, নতুন এই বিনিয়োগের ফলে প্রায় ২৩০টি পোশাক ও টেক্সটাইল ইউনিটে অন্তত ২ লাখ ২০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চলতি বছর নতুন কারখানাগুলোর মধ্যে ১৩৭টি বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ), ৬০টি বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) এবং ২৭টি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্য হয়েছে।
এ খাতে কত নতুন বিনিয়োগ এসেছে, তার সঠিক কোনো তথ্য জানা যায়নি। একটি তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনের খরচ ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে; তবে ভাড়া করা ভবনে ১০ লাইনের কারখানা স্থাপনের সর্বনিম্ন খরচ কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা। এমন তথ্যই দিয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
সেই হিসেবে, বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ'র ১৯৭ নতুন সদস্য কারখানা নির্মাণে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বা ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বলে জানান সংস্থা দুটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এছাড়া, ১৫টি নতুন টেক্সটাইল ইউনিট স্থাপন এবং আরও ১২টির সম্প্রসারণ কাজে আগেই প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ বিনিয়োগ হয়েছে ম্যানমেড ফাইবার উৎপাদনে।
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন টিবিএসকে বলেন, নতুন টেক্সটাইল প্রস্তুতকারকরা ইতোমধ্যে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য এলসি খুলতে শুরু করেছে; ২০২৩ সালের মধ্যেই কারখানাগুলোর কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রতিটি নতুন পোশাক কারখানায় ৩০০ থেকে ১ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।"
বিজিএমইএর নতুন সদস্যদের মধ্যে পাঁচটি বিদেশি কোম্পানি এবং তিনটি যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বলে জানান সংগঠনের সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম।
তিনি আরও বলেন, বিজিএমইএ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অন্যান্য বাজারের দিকেও নজর দিচ্ছে।
টিম গ্রুপ, ঊর্মি গ্রুপ, চট্টগ্রাম-ভিত্তিক প্যাসিফিক জিন্স এবং আরডিএম গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে এবং বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক রপ্তানি বাজারে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করতে কারখানায় নতুন প্রযুক্তি স্থাপনে মনোযোগ দিয়েছে।
এনভয় টেক্সটাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, কোম্পানির মূল প্রতিষ্ঠান শেলটেক গ্রুপ ডেনিম গার্মেন্টস এবং নিট কম্পোজিট কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে; ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ কারখানা দুটি উৎপাদন শুরু করবে।
"আমাদের পরিবেশবান্ধব ডেনিম কারখানাটি উচ্চ মানের পোশাক আইটেম তৈরি করবে। এছাড়া, বিদেশের একটি বিখ্যাত পোশাক প্রস্তুতকারক কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে স্থাপন হবে নিট কম্পোজিট কারখানাটি। ক্রেতাদের কাছে উন্নতমানের পণ্য সরবরাহের জন্য দুটি ইউনিটেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে," বলেন কুতুবউদ্দিন আহমেদ।
শীর্ষস্থানীয় আরেক পোশাক প্রস্তুতকারক উর্মি গ্রুপ নতুন একটি পোশাক কারখানা স্থাপনে ইতোমধ্যেই ১২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, "নতুন কারখানায় ৪০টি উৎপাদন লাইন থাকবে এবং এখানে প্রায় ৩ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।"
বাজারে শেয়ার বৃদ্ধির দিকে নজর
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)-এর গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, পোশাক রপ্তানিতে গ্লোবাল লিডার (বিশ্বনেতা) হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা আগামী দিনগুলোতে আরও সুসংহত হবে।
সুতি পোশাকের ক্ষেত্রে, বিশ্ববাজারে ১৬ শতাংশের অংশীদারিত্ব রয়েছে বাংলাদেশের। ১৭ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন; বিশেষজ্ঞদের মতে, শীঘ্রই চীনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ। তবে ম্যানমেড ফাইবার-ভিত্তিক পোশাকের ক্ষেত্রে দেশের অবদান ৫ শতাংশেরও কম।
ড. রাজ্জাক বলেন, "সুতির পোশাকে ২০ শতাংশ এবং ম্যানমেড ফাইবারে ১২ শতাংশ অবদান রাখতে পারলে বাংলাদেশ পোশাক খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় অর্জনে সক্ষম হবে।"
চীনের বৈশ্বিক বাজারের শেয়ার আরও কমতে চলেছে। তাই দ্রুত রপ্তানি সম্প্রসারণে বাংলাদেশের সামনে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, "ম্যানমেড ফাইবারসহ উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা বিশ্ববাজারে আমাদের শেয়ার বাড়াতে চাই।"
উৎপাদন বাড়াতে নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ
গার্মেন্টস, টেক্সটাইল এবং এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক পণ্য নির্মাতারা জানিয়েছেন, এই খাতের বেশিরভাগ বড় এবং মাঝারি আকারের কারখানাগুলো এখন ম্যানুয়াল মেশিন বাদ দিয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিন স্থাপন করছে।
নারায়ণগঞ্জ-ভিত্তিক ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেড সম্প্রতি ম্যানুয়াল থ্রেড কাটার সরিয়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রিমার স্থাপন করেছে কারখানায়। নতুন এই মেশিন পণ্যের সর্বোচ্চ গুণমান নিশ্চিত করে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এর পাশাপাশি কারখানার সামগ্রিক সিস্টেম স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মনিটরিং ও রিপোর্টিং সহজ হবে, যা সার্বিকভাবে বাড়াবে কারখানার উৎপাদন।
ফতুল্লা অ্যাপারেলসের সিইও এবং বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলি শামীম এহসান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের এলইইডি সার্টিফাইড গ্রিন ফ্যাক্টরিটি উৎপাদনের সময় এবং শ্রমিকদের শারীরিক পরিশ্রম কমাতে নতুন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে।"
এদিকে, উর্মি গ্রুপও কারখানায় পণ্য পরিবহনে রোবোটিক পদ্ধতি, অটো প্রেসিং এবং স্বয়ংক্রিয় ফিনিশিং মেশিন চালু করেছে।
অনন্ত অ্যাপারেলস এবং ফকির গ্রুপ তাদের অ্যাসেম্বলি লাইনের গতি বাড়াতে চালু করেছে হ্যাঙ্গার সিস্টেম।
ফজলি শামীম এহসান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
এছাড়া, গত এক দশক ধরে পোশাক উদ্যোক্তারা তাদের নিজস্ব ডিজাইন কেন্দ্র স্থাপন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। নতুন ডিজাইনের পণ্যের মাধ্যমে তাদের আয় ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশের কতটি কারখানায় বিশ্বমানের ডিজাইন স্টুডিও রয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠনের কাছে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ১০০ টিরও বেশি স্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারকদের নিজস্ব ডিজাইন এবং উদ্ভাবন কেন্দ্র রয়েছে, এরমধ্যে মধ্যে ২৫টি বিশ্বমানের।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নত যন্ত্রপাতি এবং রোবোটিক প্রযুক্তির ব্যবহারও গুরুত্ব পাচ্ছে। বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, অন্তত ৩০টি পোশাক কারখানা ইতোমধ্যে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ভবিষ্যতে পোশাক শিল্পের বিকাশের জন্য তারা সেন্টার অব ইনোভেশন, দক্ষতা এবং ওএসএইচ খাতে বিনিয়োগ করেছেন। কেন্দ্রটি মেড ইন বাংলাদেশ সপ্তাহে চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এই কেন্দ্রে উদ্ভাবন ল্যাব, ডিসটেন্স লার্নিং সিস্টেম, ডিসপ্লে, লাইব্রেরি, জাদুঘর এবং ডে কেয়ার সেন্টারের মতো সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
কেন্দ্রটি প্রযুক্তির উন্নয়ন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, উন্নত শিল্প সম্পর্ক এবং শ্রমিকদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি ব্যবসার মূল বিষয় এবং ডিজিটাল বিপণনের বিষয়েও শেখাবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের গবেষণা পরিচালক ডক্টর মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পরিবেশ, সামাজ ও প্রশাসনিক খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন।