তিন মাস কমার পর ফের বাড়ছে পোশাকের অর্ডার
টানা তিন মাস তৈরি পোশাকের (আরএমজি) অর্ডার কমতির দিকে থাকার পর সম্প্রতি পরিস্থিতির উন্নতি দেখতে শুরু করেছে এ খাতের রপ্তানিকারকরা। কিছুটা দেরিতে হলেও শীত মৌসুমের পর বসন্ত মৌসুমের পোশাকের অর্ডারের ইনকোয়ারি আসতে শুরু করেছে, যা অর্ডারের প্রাথমিক ধাপ। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাবের সময় এই প্রবণতাকে আশার আলো হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা।
অন্যদিকে আগে হোল্ড করা কিংবা শিপমেন্ট না করতে বলা পণ্যও তারা এখন নিতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন আরএমজি রপ্তানিকারকরা।
দেশের অন্যতম শীর্ষ নিটওয়্যার পোশাক রপ্তানিকারক ক্রনি গ্রুপের চেয়ারপারসন ও বিজিএমইএর পরিচালক নীলা হোসনা আরা বলেন, এখন প্রচুর ক্রেতা। তারা গত দুই-তিন মাসের তুলনায় অনেক বেশি ইনকোয়ারি ও অর্ডার করছে।
তবে অর্ডার ইনকোয়ারি বাড়লেও ক্রেতারা মূল্য কম দিতে চাচ্ছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত বেশি হারে বেসিক আইটেমের পোশাক তৈরি করে, যার চাহিদা অন্যান্য ভ্যালু অ্যাডেড পোশাকের তুলনায় বেশি।
এছাড়া শীর্ষ রপ্তানিকারক চীনের এখনও কোভিডসৃষ্ট লকডাউন থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে হয়ে আসতে না পারায় ক্রেতাদের অর্ডার স্থানান্তর করার প্রবণতাও বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হয়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ২০ দিনে পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। অক্টোবরের পোশাক রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মাস শেষে পোশাক রপ্তানি পজিটিভ হতে পারে বলে আমরা আশা করছি।'
তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের ১১ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছে টিবিএস। তাদের মধ্যে সাতজনই গত দুই-তিন মাসের তুলনায় অর্ডারের জন্য ইনকোয়ারি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাদের আগের তৈরি হওয়া পণ্য কিংবা অর্ডার হলেও তা হোল্ড করতে বলা পণ্য এখন ক্রেতারা নিতে শুরু করেছে।
রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, আগামী মাস থেকে নতুন অর্ডার পাওয়ার আশা করছেন তারা।
তবে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান বলেন, 'এতদিন অর্ডার কম থাকায় গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট থাকলেও তা খুব একটা চোখে পড়েনি। নিজেদের ক্ষতি হলেও ক্রেতার কাছে সুনাম নষ্ট হয়নি।
'কিন্তু এখন অর্ডার বাড়তে শুরু করলে গ্যাস-বিদুতের সংকটের কারণে যদি সময়মতো পণ্য শিপ করতে না পারি, তাহলে এয়ারে পাঠাতে হবে ১৪ গুণ বেশি খরচে, যার পুরোটাই নিজের ওপর বর্তাবে। সেক্ষেত্রে নিজের ক্ষতির পাশাপাশি ক্রেতার কাছে সুনামও নষ্ট হতে পারে।'
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, 'গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট রয়েছে। আবার অর্ডার নিয়ে আলোচনা হলেও মূল্য কম দিতে চাচ্ছে ক্রেতারা। সেজন্য হিসাব করেই অর্ডার নিচ্ছি।'
পোশাকের বড় বাজারগুলো মূলত চারটি মৌসুম হিসাব করে পণ্য কিনে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম বড় মৌসুম শীতের পণ্য রপ্তানি প্রায় শেষের পথে। এখন বসন্ত মৌসুমের অর্ডার আসছে। এসব পণ্য জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে রপ্তানি করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চাহিদা কম থাকায় পোশাক খাতের মূল কাঁচামাল টেক্সটাইলের দাম পড়ে যায়। তবে দেশের শীর্ষস্থানীয় টেক্সটাইল মিল মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজাহার খান বলেন, অর্ডার বাড়তে শুরু করেছে।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'বিশ্ব অর্থনীতি এখনো ডাউনটার্ন অবস্থায় রয়েছে। তবে উদ্যোক্তারা ভালো বলতে পারবেন। আর ডাটাও ইতিবাচক প্রবণতা দেখাচ্ছে।'
বিশ্ব অর্থনীতি খারাপ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ভালো অর্ডার আসার আসার পেছনে চীন থেকে ক্রেতাদের সরে আসাকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, 'বেইজিংয়ে কোভিডের কারণে লকডাউন ছিলো। আবার বৈশ্বিক রাজনৈতিক উত্তেজনাও রয়েছে। এসব কারণে ক্রেতারা অনিশ্চয়তার জন্য সেখান থেকে শিফট করছে, যার ভালো অংশ পাচ্ছে বাংলাদেশ।'
কোভিড-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি গতি লাভ করার পর—অর্থনীতিবিদরা যাকে পেন্ট আপ ডিমান্ড হিসেবে অভিহিত করেন—গত অর্থবছরে বাংলাদেশ রেকর্ড ৪২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পোশাক রপ্তানি করে, যাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ শতাংশের বেশি।
পোশাকের মূল কাঁচামাল তুলার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিও এর পেছনে একটি কারণ ছিল।
তবে চলতি বছরের শুরু থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমাগত স্থবির হতে থাকায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ধাক্কা লাগে। এর সঙ্গে শুরু হয় দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট। ফলে একদিকে অর্ডার কমতে থাকে, অন্যদিকে সার্বিক উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।