আমদানি-রপ্তানি হ্রাস, বেসরকারি আইসিডিতে ব্যবসা কমেছে ২৫%
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ায় বেসরকারি আইসিডিতে ব্যবসা কমে গেছে প্রায় ২৫ শতাংশ, কমে গেছে আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং। ক্রমাগত ব্যবসা কমায় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয় মেটাতে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে আইসিডি মালিকরা।
বাংলাদেশে ১৯টি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) রয়েছে, এগুলো অফ-ডক নামেও পরিচিত। রপ্তানি পণ্যের ৯৫% এবং চাল, গম, সরিষার বীজ, ছোলা, ডাল, স্ক্র্যাপ সহ ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য পরিচালনা করে এসব অফ-ডক। এসব আইসিডি চট্টগ্রাম বন্দরে জট কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও বন্দর এলাকার বাইরে থেকে আনলোডিং বা ডেলিভারির অনুমতি দিয়ে এফসিএল (ফুল কন্টেইনার লোড) কার্গো দ্রুত ক্লিয়ারেন্সের সুবিধার্থে কাজ করে।
চট্টগ্রামের ছোট-বড় ১৯টি বেসরকারী আইসিডিতে স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে লাভ হয় ১৬০ কোটি থেকে ১৭৫ কোটি টাকা। ব্যবসা কমায় লাভের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ফলে আইসিডির কার্যক্রম পরিচালনায় এখন লোকসান হচ্ছে। এই অবস্থা চললে ব্যবসার খরচ কমিয়ে আনতে কর্মী/শ্রমিক ছাঁটাই সহ কস্ট কাটিং বা ব্যয় হ্রাসে যাবে আইসিডি মালিকরা।
ভারটেক্স অফ-ডক লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান ফাহিম নূর বলেন, 'আইসিডিগুলো বর্তমানে চার ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করছে। এগুলো হচ্ছে, তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব, ব্যবসার ভলিউম কমে যাওয়া এবং দামে সমঝোতা। এই চার ধরনের সংকট মোকাবেলা করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আমরা রীতিমতো যুদ্ধ করছি। সহসা সংকট না কাটলে আমাদের কস্ট কাটিংয়ে যেতে হবে।'
তিনি বলেন, ভারটেক্স ডিপোতে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ টিইইউস রপ্তানি কন্টেইনার জাহাজীকরণ (জাহাজে বোঝাই) হতো। এখন সেটি নেমে এসেছে ৬০-৭০ টিইইউসে। একইভাবে আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিংও কমে গেছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) তথ্যমতে, আইসিডিতে কন্টেইনার ধারণ সক্ষমতা প্রায় ৭৬ হাজার টিইইউস। আইসিডিগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এতে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে কাজ করে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। ডিপোগুলো থেকে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের জন্য প্রতিদিন বন্দরে নেওয়া হতো দুই হাজার ৫০০ টিইইউস কন্টেইনার। এখন এই পরিমাণ কমে এসেছে এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টিইইউসে।
বিকডা সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, 'আইসিডির আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধের উপর প্রভাব পড়বে। সুদ সহ ব্যাংক ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। ২৫ শতাংশ কাজ কমে যাওয়ায় শ্রমিকের সংখ্যাও কমিয়ে দিতে হবে। সেপ্টেম্বর থেকে ক্রমাগত কমছে লাভের পরিমাণ। এখন লাভের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। বর্তমানে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনায় লোকসানে রয়েছে ডিপো মালিকরা।'
আইসিডি মালিকরা জানিয়েছেন, ব্যবসার ভলিউম কমে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন বিদেশী ক্রেতারা। সার্ভিসের ভিত্তিতে আইসিডির নির্ধারিত চার্জ থাকলেও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চার্জ কম দিচ্ছে তারা। সংকটময় মুহূর্তে তৈরী পোষাকের বিদেশী ক্রেতাদের এমন আচরণ তারা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভতুর্কি দিয়ে ডিপোর কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের (এসএপিএল) পরিচালক ও চিফ অপারেটিং অফিসার ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, 'সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানির ভলিউম ক্রমাগত কমছে। অক্টোবর থেকে কমছে আমদানিও। নভেম্বর শেষে এই পরিমাণ আরো কমে যাবে। এটি ব্যবসার জন্য ভীতিকর।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দুটি আইসিডি এসএপিএল এবং ওসিএল (ওশান কন্টেইনারস লিমিটেড) প্রতি মাসে ১৩ হাজার টিইইউস রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডল করে। এখন তিন হাজার কমে ১০ হাজার টিইইউসে নেমে এসেছে।'
এদিকে আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে পণ্য পরিবহনেও। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি পণ্য খালাস এবং রপ্তানি পণ্য নিয়ে আসা কাভার্ড ভ্যান লরির সংখ্যাও কমেছে একই হারে। পরিবহন ট্রিপ কমে যাওয়ায় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম দামে পণ্য পরিবহন করছে ট্রাকচালকরা।
বাংলাদেশ কাভার্ডভ্যান ট্রাক প্রাইমমুভার পণ্য পরিবহন মালিক এসোসিয়েশনের মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহমেদ বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চট্টগ্রাম বন্দর এবং নগরে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার পণ্য পরিবহন আসা যাওয়া করে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ায় এখন এই পরিমাণ ২৫ শতাংশ কমে গেছে।
'অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৭,৫০০ গাড়ি চলাচল করছে। গাড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় কম দামে ভাড়া নিচ্ছে শ্রমিকরা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসতে পরিবহন ভাড়া যেখানে আগে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা ছিলো সেটি এখন ১৫ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। পণ্য পরিবহন করে খরচ তুলে আনাও দুরূহ হয়ে পড়েছে।'
চট্টগ্রাম প্রাইমমুভার ট্রেইলর শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি আবুল খায়ের বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর এবং আইসিডি থেকে কন্টেইনার পরিবহনে সারাদেশে প্রায় ১৬ হাজার প্রাইমমুভার চলাচল করে। এখন সেটি নেমে এসেছে ১২ হাজারে। কাজ কমে যাওয়ায় মালিকরা শ্রমিক ছাঁটাইয়ের হুমকি দিচ্ছে। এই অবস্থায় পরিবহন শ্রমিকরা চাকরি হারানোর আতংকে রয়েছে।'