২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে ৬.৫ শতাংশ করল সরকার
অর্থনীতিবিদদের উপর্যুপরি ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার-সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন বৈঠকে চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমানোর এই প্রস্তাব করা হয়। এর আগে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল ৭.৫ শতাংশ।
করোনার ক্ষত থেকে পুনরুদ্ধারের আগেই শুরু হয়ে যাওয়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার মধ্যে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না বলে শুরু থেকেই সতর্ক করছিলেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থাগুলোও সরকারি প্রাক্কলনের বিপরীতে গিয়ে ৬ থেকে ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলে আসছে।
এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমাতে মুদ্রা সরবরাহে নিয়ন্ত্রণ, পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ির মতো নিয়ন্ত্রণমূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে শিডিউল করে করা হয়েছে লোডশেডিং।
নানামুখী নিয়ন্ত্রণ ও সংকোচনমূলক উদ্যোগের কারণে এবার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যও কমিয়ে আনছে সরকার।
এই পরিস্থিতিতে মূল বাজেটের তুলনায় সংশোধিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্য কমছে এক শতাংশীয় পয়েন্ট।
তবে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশে উঠবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের পাশাপাশি মোট বরাদ্দসহ বিভিন্ন খাতেই বড় ধরনের কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে।
সভায় বাজেটের আকার প্রায় ৬.০৭ লাখ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৬.৫৮ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ হিসাবে বাজেটে বরাদ্দ কমছে ২ হাজার ৯৩ কোটি টাকা বা প্রায় ৩ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কৃষিমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমমন্ত্রী ছাড়াও অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি ও পরিকল্পনা সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
এতে আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আদায়, মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্সসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই বৈঠকের পর বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা জানান, সভায় ভর্তুকির চাপ কমাতে কিছু পণ্য ও সেবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
তারা জানান, মূল্যস্ফীতি ও জনসাধারণের ওপর বিরূপ প্রভাব বিবেচনায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল এবং সারে দীর্ঘদিন ধরেই ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বগতির কারণে ভর্তুকির পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়তে পারে। এতে চাপে পড়তে পারে বাজেট ব্যবস্থাপনা।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমানোর প্রস্তাব করেছে অর্থ বিভাগ।
ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে শিগগিরই বাড়তি দাম কার্যকর করার সুপারিশ করা হয় সভায়।
চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের পাশাপাশি বাজেট বাস্তবায়নের সার্বিক পরিস্থিতি ও আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রক্কলন নিয়েও আলোচনা হয় সভায়।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. মো. কাওসার আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় বৈশ্বিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমানোর প্রস্তাব করেছে।
এর পেছনে কোনো অভ্যন্তরীণ কারণ ছিল না।
তিনি বলেন, জ্বালানি, সার, খাদ্য ও অন্যান্য সমস্ত উপকরণ এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সম্প্রতি বেড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের জিনিসগুলোর দাম কমবে, তেমন কোনো ইঙ্গিতও নেই।
'বড় বাজারগুলোতে মন্দার প্রভাবের কারণে রপ্তানির চাহিদাও কমে যাবে। এ কারণে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি মূল বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হবে,' যোগ করেন তিনি।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থ বিভাগ থেকে কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলকে জানানো হয়, ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
তারা জানান, খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে। এসব খাতে ভর্তুকি বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় না বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে অব্যাহতভাবে।
এসব সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হচ্ছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা। তবে এসব খাতে বরাদ্দ আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধির দাবি আসছে।
এ অবস্থায় অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি চাপ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে সভায়।
আগামী অর্থবছরে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করে ৭ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য বাজেটের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে গতকালের বৈঠকে।
সে হিসাবে চলতি বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে ৭২.১৩ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার। চলতি বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
আয় ও ব্যয়ের ব্যবধানে আগামী অর্থবছরে মোট ঘাটতির প্রাক্কলন করা হচ্ছে ২.৬৪ লাখ কোটি টাকা। চলতি বাজটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২.৪৪ লাখ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক গত অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয়।
একই সময়ে বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সংশোধিত করে এ বছরের এপ্রিল ও জুনে করা ৬.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস থেকে কমিয়ে ৬.১ শতাংশ করেছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অবশ্য ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়।