২০২৫ নাগাদ ৫ বিলিয়ন ডলারে চোখ, বিশ্বব্যাপী পদচিহ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছে স্থানীয় আইটি
তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক পরিষেবা (আইইটিএস) এবং শিল্পকাজে অটোমেশনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সুবাদে বৈশ্বিক ফুটপ্রিন্ট বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম বেড়েছে বাংলাদেশের আইটি ফার্মগুলোর। ফলে সফটওয়্যার ও অন্যান্য পরিষেবা রপ্তানির মাধ্যমে বছরে তারা ১৪০ কোটি ডলার আয় করছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর তথ্যমতে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনয়নভুক্ত দেশসহ– বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে সফটওয়্যার এবং বিভিন্ন আইটি পরিষেবা দিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে অবদান রাখছে সাড়ে তিনশ'র বেশি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট খাতের কর্মকর্তাদের মতে, বিশ্ববাজারে উপস্থিতি ধরে রাখতে এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন করেছে।
বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, "২০২৫ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন এবং ২০৩১ সাল নাগাদ ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য রয়েছে আমাদের।"
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আইসিটি রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ২৩.৬৩ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২২.৮৬ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯.৮৮ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৪.৯১ শতাংশ।
এপর্যন্ত বাংলাদেশে নিবন্ধিত সফটওয়্যার ও আইইটিএস কোম্পানির সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে তিন লাখের বেশি আইসিটি পেশাজীবীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এরমধ্যে অর্ধেকের কিছু বেশি বা ২,৩০০ কোম্পানি বেসিসের সদস্য।
বেসিসের সূত্রমতে, অব্যাহত রপ্তানি বৃদ্ধি এবং এবং স্থানীয় বাজারে অটোমেশন (প্রযুক্তি-ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয়করণ) বাড়ায় গত পাঁচ বছরে এই শিল্পের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ শতাংশের বেশি, এবং আগামী বছরগুলোতেও এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকার আশা করা হচ্ছে।
বেসিস সদস্যদের মধ্যে, গত পাঁচ বছরে রপ্তানি পরিমাণে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠান হলো– সার্ভিকইঞ্জিন, বিআইজেটি, গ্রাফিক পিপল, থেরাপ (বিডি), ব্রেইন স্টেশন ২৩, সিকিউর লিঙ্ক সার্ভিসেস বাংলাদেশ (এসইএলআইএসই), টাস্কইটার বাংলাদেশ, ক্যাফেলো বাংলাদেশ, কেএজেড সফটওয়্যার এবং গোল্ডেন হার্ভেস্ট ইনফোটেক।
২০১৮-২০২২ পর্যন্ত সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ডলার। শুধুমাত্র ২০২১-২২ অর্থবছরেই তারা ৩৫.৫৪ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করেছে।
বেসিসের তথ্যমতে, কয়েকটি শীর্ষ রপ্তানিকারকসহ ৪০টির বেশি কোম্পানি বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ-উদ্যোগ বা শতভাগ বিদেশি পুঁজিতে অফশোর ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ওডিসি) প্রতিষ্ঠা করেছে।
শীর্ষে থাকা এমন একটি প্রতিষ্ঠান হলো- বিআইজেটি, তারা মূলত বিদেশি গ্রাহকদের জন্য সফটওয়্যার ডেভেলপ বা তৈরি করে। বিভিন্ন দেশে আলাদাভাবে নিবন্ধন নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিজেআইটি লিমিটেডের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আলমগীর মোস্তফা টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের প্রায় জাপানেই আমাদের ৪৫% থেকে ৫০% বিজনেস। বাকি ব্যবসায়িক কার্যক্রম- ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশে বিস্তৃত'।
আলমগীর মোস্তফা জানান, গত অর্থবছরে তারা প্রায় ৮০ কোটি টাকা সমমূল্যের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করেছেন, আগের অর্থবছরে যা ছিল ৬০ কোটি টাকার উপরে।
পোশাক খাতের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে আইটি শিল্পের অবদান বাড়াতে ২০১৮ সাল থেকে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তবে এটি পেতে হলে অবশ্যই বেসিসের সদস্য হতে হবে।
বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে 'এন্ড টু এন্ড ক্রেডেনশিয়াল ম্যানেজমেন্ট সলিউশন্স' দিচ্ছে সুপরিচিত একটি স্থানীয় কোম্পানি টাইগার আইটি। ভুটান, মলদোভা, মাল্টা, তাজিকিস্তান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, নাইজেরিয়া, কেনিয়াসহ অন্তত ১১টি দেশে এককভাবে বা অন্য কোম্পানির সাথে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক এ এইচ এম রাশেদ সারোয়ার জানান, তাদের বিদেশি গ্রাহকদের দেওয়া আইটি সলিউশনসের মধ্যে রয়েছে– বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রি, অটোমেটেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডিন্টিফিকেশন, আইরিস রিকগনিশন এবং ফেস ডিটেকশন।
তিনি বলেন, 'তাজিকিস্তানে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজ আমরা করেছি। ইন্ডিয়ার যে আধার কার্ড, সেখানে আমরা ব্যাকহ্যান্ড সল্যুশন দিয়েছি'।
শুরুটা সহজ ছিল না
১৯৮০'র দশকে যাত্রা শুরুর পর বহুদূর এগিয়েছে বাংলাদেশের আইটি খাত।
১৯৮৫ সালে কম্পিউটার সলিউশনস লিমিটেড (সিএসএল) প্রতিষ্ঠা করেন রফিকুল ইসলাম, তখন এখাতের বেশিরভাগ কোম্পানিই শুধু হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করতো। সিএএসএল-ই প্রথম সফটওয়্যার পরিষেবা নিয়ে আসে।
এখন কোম্পানিটিতে কাজ করছেন ১০০ জনের বেশি কর্মী। শিল্পোৎপাদন, ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন খাতের দরকারি অটোমেশন ও ডিজিটাল সাপোর্ট দেয় সিএসএল।"
শুরুর দিকের স্মৃতিচারণ করে রফিকুল ইসলাম বলেন, "১৯৮৬-৮৭ সালে আমরা যখন আউটসোর্সিং শুরু করি, তখন দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশনই ছিল না। আমাদের মডেমও প্রায় কাজ করতো না। শুধু ছোট সাইজের ফাইল পাঠাতে পারতাম'।
জানালেন, সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আইটি সেবার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না বললেই চলে। ইন্টারনেট গতির দূরবস্থা ছিল অগ্রগতির প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
কম্পিউটার ও অন্যান্য এক্সসরিজ আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর পর এবং ইন্টারনেট সংযোগের উন্নতি হতে থাকায়– ১৯৯০ এর দশকে এ খাতটি চাঙ্গা হতে শুরু করে বলে জানান এই উদ্যোক্তা।
সিএসএল প্রতিষ্ঠাতা বলেন, এ খাতের আছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আপডেট করার মাধ্যমে এগিয়ে থাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে কাজ করার পরিকল্পনা আছে বলেও জানিয়েছেন।
এখনও অনেক বাধা পেরোতে হবে
বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবিরের মতে, স্থানীয় আইটি খাত এখন তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এগুলো হলো- বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের নীতিমালা ও আয় স্থানান্তর সংক্রান্ত সমস্যা, দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ ও অবকাঠামো এবং উচ্চমানের আইটি প্রোডাক্ট তৈরিতে দক্ষতার ঘাটতি।
এসব সমস্যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ব্যবসা করাটাই সবচেয়ে কঠিন বলে নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, একটি আইটি ফার্মের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "ডলার সংকটের আগেও নেপালে আমরা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইনভেস্ট করতে পারিনি, এজন্য যে ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে হয় তা আমরা দিতে পারিনি। তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) মনে করেছে যে আমরা হয়ত টাকাপয়সা পাচার করে দিব। পরে আমরা অন্য দেশ থেকে কলাবোরেশনের মাধ্যমে কাজটি করেছি।"
নীতিমালার বিষয়ে সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, আইটি ফার্মগুলো যে টাকা আয় করে তা দেশে আনতে পারে। তবে পুনঃবিনিয়োগের জন্য এ টাকা বিদেশে পাঠাতে হলে তখন ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়।
'সেজন্য অনেকে টাকাটা বিদেশ থেকে আনে না। তারা সেখানে কোথাও না কোথাও রেখে দেয় এবং খরচ করে। তাই আমরা অনেক কাজ করলেও, সে অনুযায়ী টাকা দেশে আসছে না'- যোগ করেন তিনি।
এজন্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বিধি এবং রাজস্ব নীতিমালায় কিছু সংস্কারের পরামর্শ দেন তিনি।
বেসিসের সাবেক সভাপতি বলেন, দেশের দূরপ্রান্তের জেলাগুলোকে স্বল্পমূল্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার আওতায় না আনতে পারলে আইটি শিল্পের বিকাশ হবে না।
এর পাশাপাশি ব্লকচেইন, থ্রিডি টেকনোলজি ও ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মাধ্যমে উচ্চমূল্যের কার্যাদেশ লাভের ওপরেও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
তবে সিএসএল প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলামের মতে, প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি খাতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে তা নিয়ে এখনকার গ্রাজুয়েটরা খুব একটা সচেতন নয়। এটা একটা বড় সমস্যা।
'প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হলে তাদেরকে অবশ্যই সব সময় শেখার মধ্যে থাকতে হবে'- যোগ করেন তিনি।