আমদানি, রপ্তানি, রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রাও কমল, মূল্যস্ফীতির বাড়ল
অপ্রত্যাশিত বিশ্বমন্দার প্রেক্ষাপটে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স আহরণ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে সরকার। আর গড় ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করেছে।
গত ২০ ডিসেম্বর আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক সমন্বয় পরিষদের একটি সভায় উপস্থাপিত প্রেজেন্টেশনের তথ্য অনুসারে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। আমদানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে করা হয়েছে ঋণাত্মক ৪ শতাংশ (–৪%)। প্রেজেন্টেশেনটির একটি কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে।
বৈঠকে চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সভায় আমদানি কমিয়ে আনার মাধ্যমে গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৭.৬৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ।
এটি বাজেটের প্রথম লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কম।
প্রেজেন্টেশন অনুসারে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে প্রতিশ্রুত বাজেট সহায়তা পাওয়া গেলেও রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় অর্থবছর শেষে ব্যালান্স অব পেমেন্ট নেতিবাচক থাকবে বলে প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
আগামী জুন শেষে ব্যালান্স অব পেমেন্ট মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) –২.৮ শতাংশ থাকবে বলে আশঙ্কা করছে তারা।
সরকারের ব্যয় সাশ্রয়ের পদক্ষেপ ও মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতির কারণে বেসরকারি খাতের উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রভাব জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে পড়বে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনও বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালো আছে এবং নতুন বছরেও এটি ভালো থাকবে।
চলতি অর্থবছর ৬.৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করেন তিনি। রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে।
তবে বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে গতবছর মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। আগামী বছরও সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে বলে জানান তিনি।
বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা আছে
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রেজেন্টেশনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্যমূল্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশে ব্যাপক মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ দেখা যাচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই প্রেজেন্টেশনে আরও বলা হয়েছে, 'ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এবং ইউক্রেন হতে খাদ্যশস্য রপ্তানির চুক্তি থেকে রাশিয়া পিছু হটলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চাপ সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকতে পারে।'
তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম ক্রমহ্রাসমান থাকায় মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া দেশে খাদ্য উৎপাদন অপরিবর্তিত থাকলে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমবে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮.৭৭ শতাংশ। অর্থবছর শেষে একে ৭.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার ৬.৫৯ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা।
'এই শীতের সময়ও লোডশেডিং হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মার্চ-এপ্রিলে গরমের সময় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক রাখা যায়, সেজন্য এখনও গুরুত্ব দেওয়া উচিত,' বলেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি যা হবার হবে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে।
'আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে মূল্যস্ফীতি কমবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ দেশে জ্বালানি তেল সরকার-নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়।
'আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিতে অস্থিরতা রয়েছে। যেকোনো সময় সামান্য ঘটনাতেই ভোগ্যপণ্যসহ জ্বালানির দাম আবার বাড়তে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধে অস্থিরতা বাড়লে পণ্যমূল্য কমার কোনো সম্ভাবনা নেই,' বলেন তিনি।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি বা পণ্যমূল্য কমাতে শুধু আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল না থেকে উপযুক্ত নীতি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব টিবিএসকে বলেন, 'রপ্তানির উপর আমাদের কোনো হাত নেই। সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর বাংলাদেশের রপ্তানি পরিস্থিতি নির্ভরশীল। তবে গত অর্থবছরের তুলনায় এ বছর রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেই আমরা খুশি।'
তবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পুরোপুরিই তাদের হাতে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সে কারণেই সংশোধিত বাজেটে আমদানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে।
তবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে তার প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়বে বলে সতর্ক করেন তিনি।
শিল্পোৎপাদন, ঋণ প্রবাহের ওপর নজর রাখা হচ্ছে
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, কোভিড সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময় দেশে শিল্পোৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হলেও ২০২০-এর জুলাই থেকে তা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে থাকে।
এমনকি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ও শিল্পোৎপাদন সূচক কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের উপরে ছিল।
কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত উৎপাদন খাতে উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছিল।
তবে গত জুন থেকে আগস্ট সময়কালে শিল্পোৎপাদন সূচকে পুনরায় প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে।
এই পরিস্থিতিতে সংশোধিত বাজেটে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা মূল বাজেটের ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৪.১ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে।
কমছে বাজেটের আকারও
চলতি অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে সরকার। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মোট বাজেটের ১১.১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।
এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যয়ের অগ্রগতি ৫ শতাংশ এবং পরিচালনসহ সরকারের অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়েছে ১৪.৬ শতাংশ। বি ও সি ক্যাটাগরির প্রকল্পে সরকারি অর্থ ব্যয়ে শর্তারোপ করায় গত অক্টোবর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় সমস্ত চলমান প্রকল্পকে তিনটি ক্যাটাগরিতে—এ, বি এবং সি—ভাগ করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতা সাধনসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজেটের আকারও ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করতে যাচ্ছে অর্থ বিভাগ। সেইসঙ্গে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ১৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ২ লাখ ৩১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
একইসঙ্গে সরকারের ট্যাক্স রেভিনিউয়ের লক্ষ্যমাত্রাও ৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
কোভিডকালে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলো সরকারি প্রণোদনায় দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি দ্রুতই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে বলে আশা করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
নতুন বছরে অর্থনীতি ভালো যাবে: অর্থমন্ত্রী
নতুন বছরে দ্রব্যমূল্য কমে আসবে এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সারা বিশ্ব এখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও সেই সংকট থেকে মুক্ত নয়।
এ কারণেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
রোববার ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন সচিবালয়ে অর্থবিভাগ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিয়ম শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছিল তখন মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২.৮ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে তখন মূল্যস্ফীতি কমে আসে।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বের জন্য নতুন সংকট। ইউরোপ-আমেরিকায় মন্দার পদধ্বনি।
এ কারণে পণ্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় কিছুটা চাপের মুখে রয়েছে। তবে এ দুই খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বেশ কিছু কৌশল ও পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এতে চলমান ডলার সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত এলসি নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আশা করছি, বিশ্বমন্দার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও এগিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি। ইতোপূর্বে মন্দা মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা বর্তমান সরকারের রয়েছে। সারা বিশ্ব তখন বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে। আগামীতে সংকট মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়া হবে।'
তিনি বলেন, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে অর্থবিভাগ। সেখানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো, দারিদ্র্য নিরসন এবং নতুন কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প গ্রহণে জোর দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া সংশোধিত বাজেটেও কৃচ্ছ্রতা সাধনের মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, 'আমি আশা করি, বাজারে অস্থিতিশীলতা বেশি দিন থাকবে না। সরকার এক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে না। আমরা সবাইকে সাথে নিয়ে চলমান সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। ফলে আগামীতে ভালো যাবে দেশের অর্থনীতি।'
এ সময় অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।