ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড ট্রেনসহ আরও ৪ প্রকল্পে সহায়তার কথা বিবেচনা করছে বিশ্বব্যাংক
বিশ্বব্যাংক কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করার পর ওয়াশিংটনভিত্তিক এই উন্নয়ন অংশীদারের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম দ্রুতগতির রেললাইনসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৫টি রেলওয়ে প্রকল্পের তালিকা পাঠিয়েছে সরকার। প্রকল্পগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তালিকার বাকি চারটি প্রকল্প হচ্ছে ভাঙ্গা-পায়রা বন্দর ব্রডগেজ লাইন, গ্রাহকদের বাণিজ্যিক ও অবসর কাটানোর স্থান দিতে চট্টগ্রামে আইকন বিল্ডিং, ঢাকার তেজগাঁওয়ে একটি মাল্টিমডাল ও বাণিজ্যিক হাব এবং খুলনা স্টেশন এলাকায় একটি ১ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এএম সলিমউল্লাহ বাহার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের সম্ভাবত্য সমীক্ষা হলেও বিশ্বব্যাংক সবগুলো প্রকল্পের জন্য নতুন করে জরিপ করবে। প্রকল্পগুলো পিপিপির আওতায় বাস্তবায়নযোগ্য ও আর্থিকভাবে লাভজনক হবে কি না—এসব নির্ধারণ করা হবে এর মাধ্যমে।
পিপিপি মডেলে বাস্তবায়নযোগ্য হলে প্রকল্পগুলোর নকশা তৈরি থেকে দরপত্র দলিল তৈরি পর্যন্ত প্রতিটি কাজে বিশ্বব্যাংক সহযোগিতা করবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কয়েকটি প্রকল্পে নিজেরাই অর্থায়ন করতে পারে, এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে উন্নয়ন সংস্থাটি।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরেছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, আগে একবার ঢাকা-চট্টগ্রাম দ্রুতগতির রেললাইন প্রকল্প এবং ভাঙ্গা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে বিশ্বব্যাংক।
এ দুই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবও (পিডিপিপি) পাঠানো হয় এক বছরের কিছু সময় আগে। তবে এ দুই প্রকল্পে সহজ শর্তে ঋণ দিতে কোনো সংস্থাই আগ্রহ দেখানি।
এই পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ পিপিপির আওতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, বাংলাদেশে রেলওয়েতে পিপিপি প্রকল্প সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ এতে জমি কম লাগবে, আবার ট্রেনে চলাচলের জন্য যথেষ্ট জনসংখ্যাও রয়েছে।
তবে তিনি রেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে চীন মডেল অনুসরণ করতে হবে বলে মত দেন। দীর্ঘ দূরত্বের জন্য দ্রুতগতির ট্রেন থাকবে এবং নগর এলাকায় থাকবে মেট্রোরেল।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, 'মেট্রোরেললাইন যেখানে শেষ হবে, সেখান থেকে দ্রুতগতির ট্রেনের স্টেশন থাকবে। তবে দ্রুতগতির ট্রেন দিয়ে শুধু দুটি বড় শহরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করলে হবে না। যাত্রাপথে সব বড় শহরে দ্রুতগতির ট্রেনের স্টেশন থাকতে হবে।'
দ্রুতগতির দূরপাল্লার ট্রেন এবং মেট্রোরেলের মধ্যে সমন্বয় করা গেলে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন এই প্রখ্যাত পরিবহন বিশেষজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, 'সড়ক নির্মাণে অনেক জমির প্রয়োজন হয়। সড়ক নির্মাণ ব্যয়বহুলও বটে। আবার আমাদের দেশে ব্যয়বহুল অভ্যন্তরীণ এভিয়েশনের সম্ভাবনাও কম। টেকসইভাবে যানজট দূর করে বাসযোগ্য শহর গড়তে আমাদের দ্রুতগতির ট্রেন লাগবে। এতে গ্রাম থেকে আর নগরে মাইগ্রেশন হবে না।'
বাংলাদেশেও ভারতের মতো যাত্রীসেবার পাশাপাশি পর্যাপ্ত কনটেইনার ট্রেন সেবা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি। ভারতে দ্রুতগতির ট্রেন এলিভেটেড ট্র্যাকের ওপর দিয়ে চলে, আর নিচ দিয়ে চলে দ্রুতগতির কনটেইনার ট্রেন।
এতে দেশের অর্থনীতর গতি বাড়বে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক শামসুল হক।
ঢাকা-চট্টগ্রাম দ্রুতগতির ট্রেন
২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে এই প্রকল্পের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) ইআরডির মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে পাঠানো হয়।
রেলওয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ডিজাইন কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মজুমদার এন্টারপ্রাইজ এ সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রুটে দ্রুতগতির ট্রেন চালু করতে ব্যয় হবে ১১ বিলিয়ন ডলার। এটি যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের এবং সবগুলো উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্প। দেশের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার।
সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, প্রস্তাবিত দ্রুতগতির এলিভেটেড রেলরুটের দৈর্ঘ্য হবে ২২৪.৬ কিলোমিটার। অর্থাৎ পুরো রেলপথটি হবে উড়ালপথে। মোট স্টেশন হবে পাঁচটি। তিনতলাবিশিষ্ট স্টেশনগুলোতে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাসহ সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে।
রাজধানীর কমলাপুরে প্রথম স্টেশনটি নির্মাণ করা হবে মাল্টিমডেল রেল হাবে, যেখানে বর্তমানে একটি রেল কনটেইনার ডিপো রয়েছে। সরকার এ কনটেইনার ডিপোটি গাড়িপুরের ধীরাশ্রমে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
তবে দ্রুতগতির এ ট্রেনের প্রধান স্টেশনটি হবে নারায়ণগঞ্জে, যেখানে রেলগাড়িগুলো রাখার জন্য ডিপোও থাকবে। অন্য স্টেশনগুলো হবে কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা, গোমতী, মেঘনা ও ফেনী নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ করা হবে।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রামের বর্তমান রেলস্টেশনের কাছে দ্রুতিগতির ট্রেনের আরেকটি স্টেশন হওয়ার কথা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী এই দ্রুতগতির রেলরুট আগামীতে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণ হবে।
দ্রুতগতির ট্রেন চালু হলে দেড় ঘণ্টারও কম সময়ে রাজধানী থেকে চট্টগ্রামে যাওয়া যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রায় সময় লাগবে মাত্র ৫৫ মিনিট। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম ট্রেনগুলো প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য মোট ১১ সেট ট্রেন কেনা হবে। এসব ট্রেন প্রতিদিন ৫২ বার ঢাকা-চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করবে।
বৈদুতিক এ ট্রেনের জন্য ছয়টি সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া
রেলওয়ে সূত্র জানায়, সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ডিজাইন কর্পোরেশন ঢাকা-চট্টগ্রামে দ্রুতগতির ট্রেন নির্মাণ করার প্রস্তাব দিয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে পিপিপি মডেলে এই প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানিয়েছে তারা। এক্ষেত্রে প্রকল্পের ৮০ শতাংশ মালিকানা দাবি করেছে সংস্থাটি।
এর আগে আরও দুটি চীনা প্রতিষ্ঠান—চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (সিআরসিসি) এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়রিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন (সিসিইসিসি)—ঢাকা-চট্টগ্রাম দ্রুতগতির রেললাইন নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছিল।
কর্পোরেশন দুটি জানিয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য তারা যৌথ উদ্যোগে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করবে। ওই প্রতিষ্ঠানই প্রয়োজনীয় ঋণের ব্যবস্থা করবে এবং পাঁচ বছর ধরে রেললাইন পরিচালনা করার পর তা বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করবে।
২০২০ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের দূতাবাস এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি বাংলাদেশের মাধ্যমে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়।
ওই প্রস্তাব অনুসারে, প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানটি যে ঋণের ব্যবস্থা করবে তার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় এবং সুদসহ ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার ব্যয় এবং প্রতিষ্ঠানের লাভ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
প্রতিষ্ঠান দুটি ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করবে। ঋণের মেয়াদ হবে ২০ বছর। বাংলাদেশ রেলওয়েকে ৪০ কিস্তিতে ওই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের গ্যারান্টর হবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এদিকে অস্ট্রেলিয়ার প্রোভিডাস ইনভেস্টমেন্টসও দ্রুতগতির রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আকর্ষণীয় ঋণপ্রস্তাব দিয়েছে।
২০২০ সালের ৭ অক্টোবর ঋণ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় প্রোভিডাস। বহুজাতিক এই ঋণদাতা বলেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের পুরো ব্যয় তারা জোগাবে। তাদের ঋণের মেয়াদ হবে ৩০ বছর। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে ঋণের ওপর সুদ নেবে না সংস্থাটি; এছাড়া ঠিকাদার নিয়োগের মতো কোনো কঠিন শর্তও দেবে না। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে তা সরাসরি রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এছাড়া চীন, জাপান ও জার্মানির আরও কয়েকটি সংস্থা প্রকল্পটি নির্মাণ ও অর্থায়নে আগ্রহী বলে রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সবগুলো প্রস্তাব ইআরডিতে পাঠিয়েছে মতামত দেওয়ার জন্য।
ভাঙ্গা-পায়রা ব্রডগেজ লাইন
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ইআরডিতে পাঠানো প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, ভাঙ্গা থেকে পায়রা বন্দর ও বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২১৪.৯১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পটি ৪.৯২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বাস্তবায়ন হবে। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ট্রেনের মাধ্যমে পায়রা বন্দর থেকে কনটেইনার ও পণ্য পরিবহন করা।
তেজগাঁও বিজনেস হাব
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনের আশপাশের এলাকায় ৪০ একর জায়গাজুড়ে বিজনেস হাব নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
পিপিপি মডেলে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া এই বিজনেস হাবটি হবে প্রথম ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) প্রকল্প।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটির জন্য ৯৮.৮৪ মিলিয়ন ডলার মূলধন ব্যয় এবং ০.২৪ মিলিয়ন দলাআর পরিচালন ব্যয় প্রাক্কলন করেছে।