ডলার সংকটের প্রভাব ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিতে, এলসি ওপেনিংয়ে ব্যাপক পতন
দেশে ডলারের সংকট ও বৈশ্বিক বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল, ইন্টারমিডিয়েট গুডস ও কনজ্যুমার গুডস তথা ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যাপক পতন হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি দাঁড়ায় ১.২৭ বিলিয়ন ডলারে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হওয়া ৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারের ৬৫.৩২% কম।
একইসঙ্গে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ৪.১২ ও ১.২০ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে ছিল ৪.৬৯ ও ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। বিদেশি বায়ারদের দেশ থেকে পোশাক আমদানির চাহিদা কমে গেছে। একইসঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট থাকায় ব্যবসায়ীরা চাহিদা থাকলেও আমদানি করতে পারছে না। যার কারণে সকল ধরণের আমদানির পরিমাণ কমেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের মধ্যে ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানি হয়েছে ২.৫৮ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৩.৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের এই সময়ে ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানি কমেছে ৩৩.১৮%।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালকদের অন্যতম মেসবাহুল হক বলেন, "আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমানোর একটা প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশের উৎপাদনে ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট কমে আসবে।"
"উৎপাদনকারীরা উৎপাদন বাড়াতে চাইলেই ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি বাড়ে। সামনে কী হতে যাচ্ছে এটা কেউ বলতে পারছে না। যার ফলে ক্যাপিটাল মেশিনারি ও ইন্ড্রাস্টিয়াল র' ম্যাটারিয়াল আমদানি কমেছে।"
তিনি বলেন, "গত বছর আমাদের যে পরিমাণে ক্যাপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট হয়েছে সেই পরিমাণ অর্ডার পূরণ করাই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ন্যায় এবছরও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির চাহিদা নেই। আমাদের বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হবে।"
গত বছরের এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পণ্য আমদানিতে লাগাম দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একের পর এক নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানিতে নানা শর্তের কারণে ২০২২ (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত এলসি ওপেনিং কমেছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি ওপেনিংয়ের প্রভিশনাল তথ্যে এই সময়ে দেখিয়েছে যে, প্রায় ১২ বিলিয়নের মধ্যে এলসি ওপেনিং কমেছে।
২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এলসি ওপেনিং হয় ৪৪.০১ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ এর একই সময় এলসি ওপেনিং হয় ৩৪.১০ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে ৭.৬ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যা ছিল যেকোন অর্থবছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। তবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারির ১৯ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ১০ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করতে হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, "গত অর্থবছরের অনেক এলসি পেমেন্ট ডেফার্ড ছিল। যার বড় পরিমাণে পেমেন্ট চলতি অর্থবছরের মধ্যে করতে হয়েছে। আশা করছি এখন এলসি সেটেলমেন্টের পরিমাণ কমে আসবে। যা গত কয়েকমাস যাবত দেখছি।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে, একইসঙ্গে রপ্তানির পরিমাণও বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে সামনের সময়ে ডলার বিক্রির পরিমাণ কমে আসবে।"
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৩ এর জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, চলতি অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৬.৫ বিলিয়ন ডলার।
১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩২.৪৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২১ এর আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার পরিমাণ খুবই কম। কারণ তারা এই সময়ে এলসি খোলার চেয়ে ডলার সংগ্রহে বেশি নজর দিচ্ছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে। আগে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা যেত, এখন প্রায় ১২০ টাকা লাগছে। যার কারণে বিভিন্ন ধরণের পণ্য আমদানির পরিমাণ কম।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রায় ২০টির বেশি ব্যাংকে ডলারের ব্যাপক সংকট রয়েছে। এর মধ্যে অনেক ব্যবসায়ীরা কনজ্যুমার ও ইন্টারমিডিয়েট গুডস আমদানির জন্য এলসি খুলতে চাচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলোতে ডলার না থাকায় তারা এলসি খুলতে পারছে না।
গত ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, "আমাদের অপ্রয়োজনীয় অনেক এলসি হয়েছে। এছাড়া আমদানির মাধ্যমে অনেক ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। এখন আমরা সকল আমদানিতে খুব নজরদারি করছি, এতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং অনেকটাই কমেছে।"