বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য কতগুলো কঠিন কাজ অপেক্ষা করছে!
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এখন করণীয় অনেক। এগুলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কর্মতালিকায় যোগ করা হলেও, ঋণ প্যাকেজের জন্য দেওয়া আনুষ্ঠানিক নথিতেও রয়েছে এসব সংস্কারের প্রতিশ্রুতি।
ব্যালান্স অব পেমেন্ট সহায়তা চেয়ে আইএমএফ'কে দেওয়া চিঠির সাথে 'মেমোরান্ডাম অব ইকোনমিক অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল পলিসি'তে যেসব প্রতিশ্রুতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তার কোনোটাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যান্ডেটের বাইরে নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৭২ এর আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি সবল আর্থিক ব্যবস্থা তৈরির জন্য ব্যাংকিং কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রক, পর্যবেক্ষক ও সুরক্ষাকারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে তাদের ভিশন সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সঙ্গতি ও তারল্য রক্ষায় আমরা সঠিক, দূরদর্শী, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও তথ্য প্রকাশের রূপকাঠামো প্রদান করে সার্বিক আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করব'।
কিন্তু, অনেক বছর ধরে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার পাশাপাশি, দুর্বল তদারকি ও বিধিমালার শিথিল বাস্তবায়ন আর্থিক খাতের পরিস্থিতিকে নাজুক রূপ দিয়েছে। ফলে কঠিন সংগ্রাম যেন হয়ে উঠেছে নিয়ন্ত্রকের কাজ। এমনকী মন্দ ঋণ, যা ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে জরুরি সমস্যা – শুধু যদি সেটাই সমাধান করতে হয় – তবে যেন ৮০'র দশকের সিবিএস সিরিয়ালের শক্তিমান চরিত্র 'ইনক্রেডিবল হাল্ক' এর ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পেতে আইএমএফকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণাই করতে হবে – রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের গড় নন-পারফর্মিং ঋণ (এনপিএল) বর্তমানের ২৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকের বর্তমানের ৬.২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে।
প্রকৃত অর্থে এটা করতে চাইলে তাদের প্রতিশ্রুতি অনুসারে কৌশল তৈরি এবং তার বলিষ্ঠ প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যাংককে আর্থিকভাবে সবল দেখাতে ঋণ অবলোপন করার মতো শর্টকাট নেওয়া যাবে না।
ব্যাংকিং খাত এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। যদিও বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত কয়েক বছর ধরে করোনা মহামারি পরবর্তী পুনরুদ্ধারকালে – শিথিলভাবে ঋণ পুনঃশ্রেণিকরণ ও উদার স্থগিতকরণ করা না হলে এই অংক আরো বেশি হতো।
এই মেমোরান্ডাম বা স্মারকে যৌথভাবে সই করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এতে বলা হয়েছে, একটি সামগ্রিক ও সময়নিষ্ঠ নন-পারফর্মিং ঋণ (এনপিএল) সমাধানের কৌশল ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সর্বোত্তম প্রথা অনুসারে, ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ চিহ্নিতকরণ, ঋণ শ্রেণিকরণ করা হবে।
২০২৩ সালের জুন নাগাদ আর্থিক খাতের বার্ষিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর এনপিএলসহ রিসিডিউল করা ঋণের উল্লেখ; ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্টেটমেন্ট যাচাইয়ে সম্পূর্ণরুপে ব্যাসেল-৩ মানদণ্ড গ্রহণ এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড ৯ (আইএফআরএস ৯) গ্রহণও প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে।
স্মারকে আরো বলা হয়েছে, 'ব্যাংক-ভিত্তিক এনপিএল নিষ্পত্তি ও মূলধন পুনর্গঠনের কৌশল তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর নেওয়া পদক্ষেপ তদারকিতে একটি কার্যকর নজরদারি ও বাস্তবায়ন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হবে।
ভবিষ্যতে একটি সুনিয়ন্ত্রিত আর্থিক খাত গড়ে তোলার জন্য এসকল প্রতিশ্রুতিই ভালো।
কিন্তু, গত প্রায় এক দশক ধরে যেসব কেলেঙ্কারির ঘটনা ব্যাংকিং খাতের ভিত্তিকে সজোরে নাড়া দিয়েছে– সেগুলোর কী হবে? বাংলাদশের ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলার কাজটাই বা কতোটা বিশাল হবে? রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকে বিশাল ঋণ চুরি এবং বেসরকারি খাতের ঋণদাতা ফারমার্স ব্যাংক এমন কিছু কলঙ্কিত ঘটনার উদাহরণ মাত্র।
প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সরকারি কোষাগারের অর্থে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ভল্ট ভরানো হলেও, জালিয়াতির ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যালেন্স শিট মেরামতে হিমশিম খেয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার সুবিশাল ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশের পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই ব্যাংক 'ডাকাতি'র জন্য এর সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে অভিযুক্ত করেন। এনিয়ে সংসদে আলোচনাও হলেও, পরে আরো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
২০১৯ সালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মুহিত বলেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান 'একজন প্রচণ্ড দুষ্টু লোক, তিনি একটি ভালো ব্যাংককে ধবংস করেছেন'।
'অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতির কারণেই তাকে শাস্তির মুখোমুখি করা যায়নি' বলেও জানান মুহিত। যদিও এর পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করেননি তিনি।
মুহিত বলেছিলেন, রাজনৈতিক চাপের মুখে, তিনি আরো বেসরকারি ব্যাংককে লাইসেন্স দিতে বাধ্য হন। যারমধ্যে অন্যতম ছিল ফারমার্স ব্যাংক, পরে যার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক।
সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, পদ্মা ব্যাংকের নাম পরিবর্তনের কোনো দরকার ছিল না, তার পরিবর্তে একে অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে একীভূত করা উচিত ছিল।
ব্যাংকিং খাতের সিদ্ধান্তগুলোকে অন্যান্যভাবেও প্রভাবিত করা হয়েছে।
যেমন প্রবল সমালোচনা সত্ত্বেও রাজধানীর একটি হোটেলে অনানুষ্ঠানিক এক বৈঠকে সুদহারে সীমা আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সীমা এখনও কার্যকর রয়েছে।
ডলারের বিভিন্ন বিনিময় দর নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারদের একটি অ্যাসোসিয়েশন, ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও যা এখনও সচল রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বেসরকারি ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এবং ব্যবসায়ীদের চেম্বারগুলোর চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না'।
'অপরদিকে, সরকার নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করে না। এই বাস্তবতায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশি কিছু করার নেই'। ব্যাংকিং খাতের মূল নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এসব কথা বলেন তিনি, যেকারণে এখাতের অবস্থা মন্দ থেকে আরো নাজুক রূপ নিয়েছে।
২০১২ সালে সালে খেলাপি ঋণ কমানো ও তদারকি শক্তিশালী করাসহ একই রকম তাগিদ দিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, নানান অযুহাতে এসব বাস্তবায়ন করেনি সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
এবার আর্থিক খাত টিকিয়ে ধরে রাখতে হলে – আইএমএফের শর্তগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
তবে এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা উচিত বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর। পাশাপাশি সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের নীতিনির্ধারকদের ইতিবাচক মনোভাবও দরকার।
'সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে। নাহলে বিভিন্ন অযুহাতে ব্যাংকের টাকা সরিয়ে নেওয়া হবে'- গুরুত্ব দিয়ে বলেন সালাহউদ্দিন।
একইসঙ্গে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো – উভয়ের ক্ষেত্রেই সততা, নিষ্ঠা এবং প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা – অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে প্রকৃত অর্থে সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি পালনে।
ব্যাংক-বহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেশকিছু ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার এক তদন্তে নিজেদের তদারকির ব্যর্থতা আবিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কিন্তু, গত মাসে মুদ্রানীতি প্রকাশের সময়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের নীতি এবং বৈশ্বিক পণ্যদ্রব্যের অস্থিতিশীলতার মতো বিভিন্ন কারণে তাদের দায়িত্ব আরো কঠিন হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, অভ্যন্তরীণ যেসব কারণে পরিস্থিতি আরো বাজে রূপ নিয়েছে- সেগুলো তারা অধিকাংশক্ষেত্রেই এড়িয়ে যায়।
স্মারকে যুক্ত সংস্কারের পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে সরকার ও আইএমএফ উভয়েই সম্মতি দিয়েছে। এই চিঠিতে অর্থমন্ত্রী সহ-স্বাক্ষরকারী হিসেবে থাকায় মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছাও রয়েছে। তবে যতোটা দ্রুততার সঙ্গে এগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন কতোটা হয়- সেটাই এখন দেখার বিষয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষতার ওপরও তা নির্ভর করবে, যেহেতু বেশিরভাগ কাজ তাদেরকেই করতে হবে।