আইএমএফের কর-জিডিপি অনুপাতের শর্তপূরণে তিন বছরে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে ২.৩৪ লাখ কোটি টাকা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী, আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে করের অবদান (কর-জিডিপি অনুপাত) ৯.৫ শতাংশ করতে হবে।
এই অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে এনবিআরকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাড়তি ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে।
এ বিষয়ে পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, "এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু এর বিকল্প নেই"।
"বড় সংস্কার সম্পন্ন করতে না পারলে ঋণের কিস্তি আটকে যেতে পারে। এর আগেও এমন উদাহরণ আছে, বলেন তিনি।
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)- এর 'ইমপ্লিকেশনস অফ আইএমএফ লোন কন্ডিশনস অন ডমেস্টিক রেভেনিউ মোবিলাইজেশন' শীর্ষক এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ২০১২ সালের ভ্যাট আইনও সম্মতি অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়নি।
এদিকে কর বিশেষজ্ঞদের মতে, তিন বছরে কর-টু-জিডিপি রেশিও সাড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করা এবং অন্যান্য কাঠামোগত রাজস্ব সংস্কার সম্ভব।
রাজস্ব বোর্ডের কর নীতির সাবেক সদস্য মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে কর-টু-জিডিপি রেশিও ১৭ শতাংশে উন্নীত করা। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৬ সালের মধ্যে ৯.৫ শতাংশ কর-জিডিপি রেশিও অর্জনের কথা উল্লেখ করেছে।
"আমি মনে করি, আইএমএফ-এর তহবিল দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্য সরকারের রাজস্ব সংগ্রহকে ত্বরান্বিত করবে," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন।
রাজস্ব বোর্ডের ইতোমধ্যে সম্পন্ন হওয়া সংস্কারের কথা উল্লেখ করে, তিনি ডিজিটালাইজেশন এবং রাজস্ব সংগ্রহের সমন্বয়সহ আসন্ন এজেন্ডার ওপর জোর দেন।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মোঃ ফরিদ উদ্দিন বলেন,নির্ধারিত এত অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কার সম্ভব নয়, কারণ বোর্ড এসব পরিবর্তন দ্রুত হজম করার মতো অত শক্তিশালী নয়।
"ভ্যাট আইন বিকৃত। ট্যাক্স আইন এবং শুল্ক আইন এখনো পাশ হয়নি। অটোমেশনের কথা বছরের পর বছর ধরে চলছে, উল্লেখযোগ্য আউটপুট ছাড়াই," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "সরকার বড় ধরনের রাজস্ব সংস্কার করতে ব্যর্থ হলে আইএমেফের ঋণের কিস্তি আটকে যেতে পারে। এটি আগেও অন্যান্য কয়েকটি দেশে ঘটেছে।"
আইএমএফের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহের বিপরীতে কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭.৮ শতাংশ।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে, এই লক্ষ্যপূরণ সম্ভব বলে মনে করছে পিআরআই।
আইএমএফের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করে রাজস্বব বোর্ড জানিয়েছে, বাংলাদেশকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত ০.৫ থেকে বাড়িয়ে ৮.৩ শতাংশ করতে হবে। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হতে পারে প্রায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফ'র লক্ষ্য পূরণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডকে মোট আদায় করতে হবে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আদায় করতে হবে ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের ওপর আলোচ্য ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এনবিআরকে প্রবৃদ্ধি করতে হবে প্রায় ৭৮ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছর থেকে প্রতি বছর গড়ে আদায় বাড়াতে হবে ২০ শতাংশ করে।
অবশ্য গত পাঁচ বছরে রাজস্ব আদায় বেড়েছে গড়ে ১৪ শতাংশ হারে। ফলে এত বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে।
সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রক্ষেপণের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এবং গবেষণা পরিচালক এমএ রাজ্জাক।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু এর বিকল্প নেই। বড় সংস্কার সম্পন্ন করতে না পারলে ঋণের পরবর্তী কিস্তি আটকে যেতে পারে। এর আগে এমন উদাহরণ আছে।
"এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে অবস্থা খারাপ হবে। শর্ত পূরণ না করেও উপায় নেই," বলেন তিনি।
গত পাঁচ বছরের হিসাব অনুযায়ী, ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও কমতির দিকে। এ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. মনসুর বলেন, "বড় সংস্কারের শর্ত পূরণ করতে না পারলে ঋণের কিস্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর আগে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের শর্ত পূরণ করা হয়নি। ফলে ঋণের সর্বশেষ এক বা দুই কিস্তি আটকে দেওয়া হয়েছিল।"
"এছাড়া পলিটিক্যাল ইকোনমি বিবেচনায় মূলত সংস্কার আটকে যায়। রাজনৈতিক ডাইরেক্টিভ না পাওয়ায়, ২০১২ সালের ভ্যাট আইনও বাস্তবায়ন হয়নি," যোগ করেন তিনি।
এম এ রাজ্জাক তার উপস্থাপনায় বলেন, রাজস্ব খাতের ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জের হবে। তবে এটা অসম্ভব নয়। এজন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে।