চীনের পরিবর্তে ভারত থেকে সস্তায় কৃত্রিম তন্তু আমদানির দিকে ঝুঁকছে পোশাক খাত
প্রতিযোগী মূল্য, এবং দুটি স্থলবন্দর চালু হওয়ার মাধ্যমে সড়কপথে আমদানির পথ উন্মুক্ত হওয়ায় লিড টাইমের সুবিধা নিতে ম্যান-মেইড ফাইবার (কৃত্রিম তন্তু) ও ফেব্রিক আমদানিতে চীন নির্ভরতা কমিয়ে ভারতমুখী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ। রপ্তানি সম্ভাবনাময় নন-কটন পোশাকের মূল এ কাঁচামালের বৈশ্বিক চাহিদাও বাড়ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের চীন-বিরোধী অবস্থানও বাংলাদেশের ভারতমুখী হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে। আগামী পাঁচ বছরে প্রতিবেশী দেশটি থেকে এই আমদানি বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচামালের জন্য বিকল্প উৎসমুখী হওয়া বাংলাদেশের কৃত্রিম তন্তু শিল্পের বিকাশকে সমর্থন করবে এবং চীন-নির্ভরতা কমাবে।
গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকার বেনাপোল ছাড়াও নতুন দুটি স্থলবন্দর – সাতক্ষীরার ভোমরা এবং চাপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে – কৃত্রিম সুতা ও ফেব্রিক আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
বাংলাদেশে এ পণ্য বেশি হারে রপ্তানির সম্ভাবনা খুঁজতে গত মাসে গুজরাটের সুতা ও ফেব্রিক উৎপাদনকারী ৬০টি প্রতিষ্ঠান ঢাকায় গার্মেন্টস এক্সেসরিজের একটি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে, যাদের বেশিরভাগই ম্যান-মেইড ফাইবার বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত।
প্রতিবেশী দেশটি থেকে আমদানির সম্ভাবনা খুঁজতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন (বিজিএমইএ) এর একটি প্রতিনিধিদল বুধবার ভারত সফরে যাচ্ছে, যার নেতৃত্ব দেবেন সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, 'গুজরাট, আহমেদাবাদ এলাকার ম্যান মেড ফাইবারের সুতা ও ফেব্রিকের জন্য বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। বাংলাদেশও এ ধরনের কাঁচামালে উৎপাদিত পোশাকপণ্য রপ্তানিতে মনোযোগ বাড়িয়েছে। ফলে কাঁচামালের জন্য আমরা সেখানে (ভারতের দিকে) মনোযোগ বাড়িয়েছি, যা আমাদেরকে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়তা করবে'।
'নতুন স্থলবন্দরগুলি চালু হওয়ায় তা লিড টাইম কমাতে সহায়তা করবে। আমরা ইন্ডিয়া থেকে এ ধরনের ইয়ার্ন ও ফেব্রিক আমদানি করে ডিজাইন, ডেভেলপ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে নন-কটন পোশাক রপ্তানি করতে চাই। ইন্ডিয়াতেও রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে' বলে জানান তিনি।
কৃত্রিম তন্তুতে তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজার ক্রমেই বাড়ছে, অন্যদিকে কটন পোশাকের চাহিদা কমতির দিকে। যদিও বাংলদেশের ক্ষেত্রে এটি উল্টো, অথচ কটনের চেয়ে কৃত্রিম তন্তুতে তৈরি পোশাকের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক স্প্যারো গ্রুপ। তাদের বেশিরভাগ পণ্যই উচ্চ মানের পোশাকপণ্য। স্প্যারো ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানি বাড়াচ্ছে।
বার্ষিক ২০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি আয়কারী এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগে আমাদের চাহিদার প্রায় পুরোটাই পুরোটাই চীন থেকে আমদানি করতাম। গত বছর এর ২০ শতাংশ কাঁচামাল ভারত থেকে আমদানি করেছি। এতে লিড টাইমের পাশাপাশি মান ও দামেও প্রতিযোগী সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে'।
এসব কাঁচামাল আমদানির জন্য নতুন বন্দর চালু হওয়া এবং আংশিক চালান (পুরো কনসাইনমেন্ট কয়েক চালানে আসা) উন্মুক্ত হওয়ায় আমদানি আরো বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জ- ভিত্তিক ফতুল্লাহ ফ্যাশনস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে শামীম এহসান জানান, তার কোম্পানি স্পোর্টসওয়্যার এর জন্য পলিয়েস্টার ফেব্রিক ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করেছে, যা আগে চীন থেকে আমদানি হতো।
তিনি বলেন, 'সব সময় যে দামে সুবিধা পাওয়া যায়, তা নয়। তবে লিড টাইমে সুবিধা পাওয়া যাবে। এছাড়া, আমদানি প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় আমাদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হলো'।
২০২১ সালে পোশাকপণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল ৪৪০ বিলিয়ন ডলারের, এরমধ্যে কৃত্রিম তন্তুতে তৈরি পোশাকের বাজার ছিল ৫০ শতাংশের বেশি। সে তুলনায়, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৭২ শতাংশ ছিল কটন-ভিত্তিক, ২৪ শতাংশ কৃত্রিম তন্তুর এবং বাকি পণ্য ছিল সিল্ক, উল ও অন্যান্য উপকরণে প্রস্তুতকৃত।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এর গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আগামী বছরগুলোতে কৃত্রিম তন্তুতে প্রস্তুতকৃত কাপড়ের বাজার বড় হতে থাকবে, কটনের তুলনায়।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট ম্যান-মেড ফাইবারের রপ্তানিকৃত পোশাকের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশের মত অবদান রেখেছে করেছে স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো। বাদবাকী আমদানিকৃত কাঁচামালের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে চীন থেকে। আর ভারত থেকে আমদানি হয় ১০ শতাংশ।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম মনে করেন, আগামী পাঁচ বছরে ভারত থেকে আমদানি দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে স্থানীয় সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।
র্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক টিবিএস'কে বলেন, 'ভূরাজনৈতিক কারণে চীনের উপর যেকোন সময় আরো বিধিনিষেধ আসতে পারে। এজন্য চীনের উপর নির্ভরতা কমানোর অংশ হিসেবে অন্য দেশ থেকে সোর্সিং বাড়ছে। বাংলাদেশ ইন্ডিয়াতে সুবিধা পেলে, সেখান থেকে আমদানি বাড়তে পারে'।
অবশ্য কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে বায়ারদের একটি ভূমিকা থাকে। এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অনেক ব্র্যান্ডই একটা দেশের উপর তাদের সোর্সিংয়ের ৫০ শতাংশের বেশি ডিপেন্ডেসি রাখতে চায় না। এজন্য অনেকে চীন থেকে সরছে'।
আমদানি নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশেই কৃত্রিম তন্তুর কাঁচামাল উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন দিনি।
স্থানীয় টেক্সটাইল মিলের অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ
র্যাপিডের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের কটনভিত্তিক পোশাকের প্রায় ৬৫ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো সরবরাহ করলেও, তা কৃত্রিম তন্তুর ক্ষেত্রে মাত্র ১৫ শতাংশ। যদিও বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম মনে করেন, এই অংশ তার চেয়েও কম হবে।
অতীতে স্থানীয় পোশাক উদ্যোক্তা ও বায়ারদের কাছে চাহিদা কম থাকায় এবং বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের দিকটি যুক্ত থাকায় অনেকে এ খাতে বিনিয়োগে আসতে চাইতেন না। অবশ্য দিনে দিনে চাহিদা বাড়তে থাকায় অনেকেই বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে গত দুই বছরে এবং প্রায় ৫০টি কারখানা কমবেশি নন-কটন পোশাকের কাঁচামাল তৈরি করছে।
সিন্থেটিক ও ব্লেন্ডেড সুতা উৎপাদনে নতুন স্থাপনা গড়ে তুলছে নোমান গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, ম্যাকসন্স গ্রুপ এবং শাশা ডেনিম। এমন কিছু কারখানা ইতোমধ্যে উৎপাদনেও গেছে।
এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবুদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের কারখানা আগামী মাস থেকে ব্লেন্ডেড ইয়ার্ন (কটন ও কৃত্রিম সুতার মিশ্রণ) উৎপাদনে যাচ্ছে। প্রতিদিন উৎপাদন হবে প্রায় ৩০ মেট্রিক টন'।
চাহিদা অনুযায়ী এ খাতে বিনিয়োগ না বাড়ার কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এক সময় চাহিদা কম ছিল। পরবর্তীতে কটনের দাম বাড়তে থাকায়- কৃত্রিম তন্তুতে প্রস্তুতকৃত পোশাকের চাহিদা বাড়ে। ফলে এখাতে বিনিয়োগও আসছে।
সম্ভাবনা দেখছেন ভারতীয় রপ্তানিকারকরা
গত জানুয়ারিতে ঢাকায় 'ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল অ্যান্ড ট্রেড ফেয়ার (আইটিটিএফ)' নামে একটি প্রদর্শনীতে ভারতের ৬০টি প্রতিষ্ঠান তাদের সুতা ও ফেব্রিক নিয়ে হাজির হয়েছিল, যার বেশিরভাগই গুজরাটের। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই কৃত্রিম তন্তু ও মিশ্র সুতাসহ বিশেষায়িত ফেব্রিকের প্রদর্শনী করছে, যা নারীদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক, ব্রাইডাল ড্রেস, গাউন, শাড়ি, শিশুদের পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এসব সুতা ও ফেব্রিকে তৈরি পোশাক অপেক্ষাকৃত উচ্চ মূল্যের।
প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া গুজরাটের খুশি ফেব্রিক্স এর প্রতিনিধি সঞ্জয় গাদিয়া টিবিএস'কে বলেন, 'বর্তমানে আমরা কলকাতার থার্ড পার্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে রপ্তানি করছি, যার পরিমাণ বছরে ৬ কোটি ডলার। তবে বাংলাদেশে এ পণ্যের চাহিদা আরও বাড়বে বলে আশা করছি'।
প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া আরো একাধিক ভারতীয় কোম্পানির প্রতিনিধিরাও ভবিষ্যতে বাংলাদেশে তাদের রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনার কথা জানান।