ডলার সংকটে বন্ধ পুনর্বিমার প্রিমিয়াম, চিন্তায় বিমাকারীরা
ডলার সংকটে বড় সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশের বিমা শিল্প। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি পুনর্বিমাকারীদেরকে প্রিমিয়াম জমা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে স্থানীয় বিমাকারীদের জন্য।
গত পাঁচ মাস ধরে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি প্রিমিয়াম আটকে রয়েছে। এর ফলে দেশের বিমাকারীদের মধ্যে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যপটের আশঙ্কা করে বীমাকারীরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, তারা যদি প্রিমিয়ামগুলো পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে বিদেশি পুনর্বিমাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো — যারা স্থানীয় বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বেশি বড় ঝুঁকিগুলোর ভাগাভাগি ও ব্যবস্থাপনা করে থাকে — তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো ঝুঁকি কাভারেজ নিতে রাজি হবে না। পাশাপাশি বিদ্যমান চুক্তিও বাতিল করে দেবে।
এছাড়া এর প্রভাব পড়বে অন্যভাবেও। এমন পরিস্থিতি ঘটলে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই), মেগা প্রকল্পসহ বহু সম্পদ আর বিমার আওতায় থাকবে না। এতে বিমাকারী ও পলিসিহোল্ডার (যার নামে বিমা করা হয়েছে) উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
দেশের একমাত্র নন-লাইফ বিমাকারী এবং পুনর্বিমাকারী সংস্থা সাধারণ বীমা কর্পোরেশন (এসবিসি) সর্বোচ্চ ৪০০ কোটি টাকার সম্পত্তির পুনর্বিমা করতে পারে। এ কারণে স্থানীয় বিমা কোম্পানিগুলোকে কেপিআই, মেগা প্রকল্প ও ৪০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের কারখানার জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পুনর্বিমা নিতে বাধ্য হয়। পুনর্বিমা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদেরকে এই বিদেশি পুনর্বিমাকারীদের কাছে নিয়মিত প্রিমিয়াম পাঠাতে হয়।
রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. খালেদ মামুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিনিষেধের কারণে চার মাসের বেশি সময় ধরে আমরা একটা ডলারও পাঠাতে পারিনি। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে একটা বিপর্যয় ঘটবে।'
খালেদ জানান, তারা যখন বিদেশি পুনর্বিমাকারীদের সঙ্গে পলিসি পুনর্বিমা করেন, তখন প্রিমিয়াম পরিশোধের জন্য তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় — ৬০ থেকে ৯০ দিন — বেঁধে দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রিমিয়াম পরিশোধ করা না হলে বিমা পলিসি বাতিল হয়ে যাবে।
পুনর্বিমা হলো একটি বিমা কোম্পানির ঝুঁকি অপর একটি বিমা কোম্পানিতে স্থানান্তর করা। এতে প্রিমিয়ামের বদৌলতে বিমা কোম্পানি দুটি বড় ক্ষতির ঝুঁকি ভাগাভাগি করে নিতে পারে। এ পদ্ধতি ঝুঁকি ছড়িয়ে দেওয়া এবং বিমা কোম্পানিগুলোকে বড় ক্ষতির বিপরীতে একটি সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে রাখতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের আইন অনুসারে, সমস্ত বেসরকারি বিমাকারীর নিজেদের ব্যবসার ৫০ শতাংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসবিসির সঙ্গে পুনর্বিমা করা বাধ্যতামূলক — আর বাকি অর্ধেক দেশের বাইরে পুনর্বিমা করা যায়। কিন্তু সব কোম্পানির বিদেশি পুনর্বিমাকারীর সঙ্গে ব্যবসা নেই।
বাংলাদেশের ৪৬টি নন-লাইফ বিমা কোম্পানির মধ্যে প্রায় ১২টি যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও ভারতের কোম্পানির সঙ্গে তাদের ব্যবসা পুনর্বিমা করে। বাকি কোম্পানিগুলো এসবিসির সঙ্গে পুনর্বিমা করে। এসবিসি পরবর্তীকালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ঝুঁকি ভাগাভাগি করে নেয়।
বাজারসংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুসারে, কোম্পানিগুলো ২০২২ সালে বিদেশে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার (প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার) পুনর্বিমা করেছে।
যেসব কোম্পানি তাদের পলিসি বিদেশে পুনর্বিমা করে, সেগুলোর মধ্যে আছে গ্রীন ডেল্টা, পাইওনিয়ার, ও রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স। ডলার সংকটের জন্য প্রিমিয়াম পাঠাতে না পারায় এই কোম্পানিগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গ্রীন ডেল্টার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা চৌধুরী তাদের বিদেশি পুনর্বিমাকারীদের প্রিমিয়াম প্রদানের বর্তমান সংকট সম্পর্কে বলেন, 'এটা আমাদের জন্য সংকটময় সময়।'
তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির পথে রয়েছে এবং অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর সেই প্রকল্পগুলোর পুনর্বিমা প্রয়োজন, কারণ এসবিসি একা এই পুনর্বিমা করতে পারে না।
ফারজানা বলেন, পরিস্থিতি দ্রুত ঠিক না হলে বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে তাদের ব্যবসা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
লন্ডনভিত্তিক বিমা ব্রোকার টাইসারস-এর কান্ট্রি ম্যানেজার এস এম মইনুল ইসলাম বলেন, তারা গত বছরের মে থেকে প্রিমিয়াম জমা দিতে পারছেন না। আর বাংলাদেশ ব্যাংক বা বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেউই এ বিষয়ে তাদের কিছু জানাচ্ছে না।
তিনি বলেন, 'আমরা যদি এ মাসের মধ্যে প্রিমিয়াম পাঠাতে না পারি, তাহলে এপ্রিল থেকে পলিসি নবায়ন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।'
টাইসারস বাংলাদেশের প্রধান বলেন, স্বনামধন্য বিমাকারীরা বাংলাদেশকে ছেড়ে চলে গেলে বাজারের দখল নেবে নিম্নমানের পুনর্বিমাকারীরা। এরা দুর্ঘটনার বিমা দাবি পরিশোধের কোনো বাধ্যবাধকতা আছে বলে মনে করে না।
এসবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, তাদের নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রার অ্যাকাউন্ট আছে। বিদেশি পুনর্বিমাকারীদের কাছে ডলার পাঠাতে এসবিসির কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
তবে নন-লাইফ বিমাকারীদের স্পন্সরদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন প্রিমিয়াম পরিশোধের সমস্যাটি সম্পর্কে অবগত নন বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তারা বিদেশে বিমার প্রিমিয়াম পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক রোববার টিবিএসকে বলেন, 'এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওপর। ব্যাংকগুলোর অন্যান্য অগ্রাধিকার থাকতে পারে।'
জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর সমস্যা হচ্ছে না
আন্তর্জাতিক জীবন বিমা শিল্পে পুনর্বিমা খুব সাধারণ ঘটনা, তবে এই চর্চা বাংলাদেশে নেই।
জীবন বিমার আর্থিক আওতা কম, এ কারণে এ বিমার ৯৮ শতাংশের বেশি পলিসিই স্থানীয় বিমাকারীদের কাছে থাকে। স্থানীয় বিমাকারীরা জীবন বিমা-সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলো বিদেশি বিমা কোম্পানির সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
দেশের অন্যতম বৃহৎ জীবন বিমা কোম্পানি ডেল্টা লাইফের পরিচালক আদিবা রহমান বলেন, তারা নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলির মতো প্রিমিয়াম পাঠাতে না পারার সমস্যায় ভুগছেন না।
এর অর্থ, নন-লাইফ বিমা শিল্প যে সমস্যা পোহাচ্ছে, দেশের জীবন বিমা খাতের ওপর সেই সমস্যার প্রভাব পড়ছে না।
ডলার পরিস্থিতি
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ মার্কিন ডলারের সংকটে ভুগছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য, জ্বালানি, সার ও শিল্প উপকরণসহ প্রায় সব পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে আমদানির জন্য ডলারের সংস্থান করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে রিজার্ভ কমে এখন ৩২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত ছয় মাসে স্থানীয় মুদ্রা টাকার দাম ২০ শতাংশ কমানো হয়েছে।