বিশ্ববাজারে কমলেও আমাদের পণ্যের দাম কেন চড়া থাকে?
যুদ্ধের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপীয় দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মূল্যস্ফীতি কমছে। কিছুক্ষেত্রে তা বিশেষজ্ঞদের শঙ্কাকেও অবজ্ঞা করছে। বৈশ্বিক প্রবণতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, আমাদের নিকট প্রতিবেশী চীন আর ভারতেও পতনের দিকে মূল্যস্ফীতির কাঁটা।
কিন্তু, বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। এদেশে বিশ্ববাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম বাড়লেই, রুদ্ধশ্বাস গতিতে দেশের বাজারে দাম বাড়ে, কিন্তু বৈশ্বিক মূল্য পতনের বেলায়- সে হারে কমে না।
অর্থনৈতিক তথ্যউপাত্তে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হার ৬.৪ শতাংশে নেমে আসে, যা গত বছরের জুন মাসে হওয়া ৯.১০ শতাংশ বা চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। একইভাবে, অক্টোবরের ১০.৪ শতাংশের রেকর্ড উচ্চতা থেকে জার্মানির মূল্যস্ফীতি এক-চতুর্থাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম কমতে থাকায় – ইউরো-অঞ্চলে গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি নাগাদ মূল্যস্ফীতি ২.১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে।
কিন্তু, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি হার কমেছে বেশ দুর্বলভাবে; গত বছরের আগস্টে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বা ৯.৫২ শতাংশ থেকে জানুয়ারিতে কমে ৮.৫৭ শতাংশ হয়েছে। এতে ইঙ্গিত মেলে যে, আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতনের সময়েও- পণ্যের দাম কমার চেয়ে বৃদ্ধির হারই বেশি।
উদাহরণস্বরূপ; গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববাজারে গমের দাম প্রতিবুশেল ৮ ডলারে নেমে আসে, কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে দাম কমেনি। বর্তমানে প্রতিকেজি আটা বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকায়, আগের বছরের তুলনায় যা ৫১ শতাংশ বেশি। একইভাবে, বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেল ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ইউক্রেন যুদ্ধপূর্ব পর্যায়ে ফিরলেও, দেশের বাজারে তার ধারাবাহিকতা দেখা যায়নি। এমনকী বিশ্ববাজারে দাম কমতে শুরু করলেও সরকার-নির্ধারিত জ্বালানি তেলের দাম কমেনি।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশে দ্রুত দাম বৃদ্ধি এবং সেই হারে না কমার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। একটি অন্যতম কারণ হলো, গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে স্থানীয় মুদ্রার ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন। আরেকটি যে কারণ বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন তা হলো- জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজস্ব ও মুদ্রানীতি- উভয়ক্ষেত্রে যথাযথ নীতিগত পদক্ষেপের ঘাটতি। আবার কিছুক্ষেত্রে গুটিকয় কোম্পানির আধিপত্য দিয়ে স্থানীয় বাজারদর প্রভাবিত হচ্ছে, ফলে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসের সুবিধা পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বিআইডিএস- এর গবেষণা পরিচালক ড. মঞ্জুর হোসেন মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং বিনিময় হারে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হওয়ায় অন্যান্য দেশের মতো দ্রুত হারে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কমছে না।
তার ব্যাখ্যা মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানো একটি প্রচলিত পদ্ধতি হলেও, কিন্তু বাংলাদেশ তা করতে পারেনি। কিছু মূল্যস্ফীতি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যেমন প্রান্তিক মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি এবং মজুরি ও বেতন বৃদ্ধি, বাংলাদেশে বাস্তবায়িত করা যায়নি।
তাই বিশ্ববাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম কমলেও, ডলার সরবরাহের সাথে সম্পর্ক থাকায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অচিরেই কমবে না বলেও পূর্বাভাস দেন ড. মঞ্জুর। যেহেতু ডলার স্বল্পতার কারণেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্য আনতে পারছেন না আমদানিকারকরা।
মূল্যস্ফীতিকে কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনা করতে নীতিনির্ধারকদের আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির 'পাস-থ্রু' প্রভাব বিশ্লেষণের পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল-ও বাংলাদেশের অব্যাহত মূল্যস্ফীতির জন্য স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং মার্কিন ডলারের সংকটকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, 'ভোক্তাদের দাম কমে যাওয়া থেকে উপকৃত হওয়া উচিত, কিন্তু বিনিময় হারের অসুবিধা তাতে বাধা দিচ্ছে'। তিনি এখনও ব্যাংকের জন্য নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি দরে ঋণপত্র বা এলসি খুলছেন বলেও উল্লেখ করেন।
তাছাড়া বাজারে পণ্যের ঘাটতি রয়েছে, যা প্রতিযোগিতা ও ন্যায্যমূল্যকে নিরুৎসাহিত করছে বলেও উল্লেখ করেন কামাল।
এদিকে শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বড় আমদানিকারকরা গতবছর বিনিময় হারের কারণে বিপুল লোকসান করেন। তারা প্রতিডলার ৮৬ টাকা দরে এলসি খুললেও, নিষ্পত্তি করেছেন ১০০ টাকার বেশিতে। এতে তাদের অনেক লোকসান হয়। এখন তারা সেই লোকসানের বোঝা ভোক্তার ওপর পার করে দিচ্ছে বলে জানান একটি পণ্যবাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য দেশ যেসব কৌশল প্রয়োগ করে
একটি দেশের সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও নীতিগত লক্ষ্যের ওপর তাদের গৃহীত কৌশলগুলো নির্ভর করলেও, এমনকিছু সর্বজনীন পদ্ধতি আছে বিশ্বব্যাপী যার বহুল ব্যবহার হচ্ছে।
এরমধ্যে প্রথমেই বলতে হয় মুদ্রানীতির কথা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে, সুদহার বাড়িয়ে বাজারে নগদ অর্থ সরবরাহকে সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পণ্য ও সেবার চাহিদা কমাতে পারে, এতে অর্থনীতি কিছুটা মন্থর হয়ে মূল্যস্ফীতির পতন হয়।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক তাদের মৌলভিত্তির সুদহার কয়েক দফায় বাড়িয়ে ৪.৭৫ শতাংশ করেছে, যা এক বছর আগেও ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যৌক্তিক পদক্ষেপের আহ্বান সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার সীমা ৯ শতাংশেই রেখেছে। এই সীমা ২০২০ সালে নির্ধারণ করা, যখন লকডাউনের প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় টাকার চাহিদা ছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
এরমধ্যে এক বছর আগে ৬ শতাংশেরও কম থেকে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বা ৯.৫২ শতাংশ হয় মূল্যস্ফীতি। এই প্রেক্ষাপটে, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অর্থনীতিবিদরা বার বার আহ্বান জানানোর পরও সুদহার অপরিবর্তিতই রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দ্বিতীয়ত, বলতে হয় রাজস্ব নীতির কথা। মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করতে নিজস্ব কর ও ব্যয় নীতিকে ব্যবহার করতে পারে সরকার। যেমন সরকার চাইলে আমদানি করা পণ্য- বিশেষত নিত্য খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে কর ও শুল্ক কমাতে পারতো। এতে দেশের বাজারেও দাম কম থাকতো।
এই বাইরে, মুদ্রা বিনিময় হার নীতির মাধ্যমে – নিজ মুদ্রার বিনিময় দর নির্ধারণ করেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে পারে একটি দেশ। স্থানীয় মুদ্রার মান দুর্বল থাকলে– আমদানি করা পণ্যেরও দাম বেড়ে যায়, এতে মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বগামী হয়। অপরদিকে, স্থানীয় মুদ্রার তেজিভাব মূল্য কমায়। বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার দুর্বলতাই মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিচ্ছে।
এছাড়া সরবরাহ বা জোগানের নীতিও একটি উপায়। নিজ অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার জোগান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে একটি দেশ। জোগান বাড়লে মূল্যস্ফীতি প্রশমিত হতে পারে। সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য ব্যবসার জন্য বিধিমালা কমানো, অবকাঠামোয় বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করার মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
কিছু দেশ মুল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মজুরি এবং পণ্যের দামকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সূচক ব্যবহার করে; যা অনেক সময় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে এবং মূল্যস্ফীতির অভিঘাত কমাতে সাহায্য করে। তবে, এই পদ্ধতিটি মজুরি ও মূল্যবৃদ্ধির পাকচক্রেও রূপ নিতে পারে; অর্থাৎ যে অবস্থায় উচ্চ মূল্যের সাথে তাল মিলিয়ে উচ্চ মজুরি নির্ধারণ করায়, তাতে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যায়, তখন মজুরি আবারো বৃদ্ধি করতে হয়।