ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন: বিশেষজ্ঞরা
এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে বিদেশি ফার্মা হাউজগুলোর সরাসরি বিনিয়োগ এবং জয়েন্ট কোলাবরেশন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট শিল্প বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডাররা।
তারা বলছেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে স্নাতক হবে। তখন আর ওষুধ উৎপাদনে বিনামূল্যে পেটেন্ট সুবিধা পাওয়া যাবে না। ফলস্বরূপ, দেশে ওষুধ উৎপাদন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই ওষুধের দাম যেন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সোমবার (১৩ মার্চ) বাংলাদেশ বিজনেস সামিট ২০২৩-এর তৃতীয় এবং শেষ দিনের অধিবেশনে বিষয়টি তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে বর্তমানে বিনামূল্যের এই পেটেন্ট সুবিধায় যে ওষুধগুলো উৎপাদন হচ্ছে, সেগুলো ট্রেড-রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অফ ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রোপার্টি রাইটস বা সংক্ষেপে ট্রিপস চুক্তির আওতায় ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বজায় থাকবে। কিন্তু এলডিসি স্নাতকের কারণে ২০২৬ এরপর নতুন কোনো জেনেরিকে ওষুধ এলে বাংলাদেশ তখন বিনামূল্যে পেটেন্ট সুবিধা পাবে না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনে বক্তারা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) সভাপতি নাজমুল হাসান প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, "এলডিসি থেকে উত্তরণের পরের পথচলা কোন দেশের জন্যই মসৃণ ছিল না। অন্য দেশগুলোর মতো আমাদেরকেও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।"
তিনি বলেন, "এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণে আমাদের দুটি পথ রয়েছে। প্রথমত, বিদেশি ওষুধ প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে সরাসরি বিনিয়োগ দেশে আনা এবং দ্বিতীয়ত, গ্লোবাল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর লাইসেন্সের অধীনে ওষুধ তৈরির জন্য বিদেশি ও স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারকদের মধ্যে জয়েন্ট কোলাবোরেশন বা যৌথ সহযোগিতা স্থাপন করা।"
বাংলাদেশের ফার্মা সেক্টরে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, "আমাদের ৩০টিরও বেশি কোম্পানি আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে লেটেস্ট টেকনলজি ব্যবহার করে ওষুধ উৎপাদন করছে। আমাদের কোম্পানিগুলো স্থানীয় চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ করছে। পাশাপাশি ওষুধ রপ্তানির জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর কাছ থেকেও অনুমোদন পেয়েছে। বছরে ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে কোম্পানিগুলো।"
তিনি উল্লেখ করেন, গ্লোবাল ড্রাগ জায়ান্ট গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) ওষুধ উৎপাদনের খরচ কমাতে যুক্তরাজ্য থেকে তাদের কারখানা সিঙ্গাপুরে সরিয়ে নিয়েছে।
"অথচ বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের থেকেও ৩০-৪০ শতাংশ কম খরচে ওষুধ উৎপাদন করতে পারে। সুতরাং আমাদের গ্লোবাল ড্রাগ মেকার হাব হওয়ার মতো সক্ষমতা রয়েছে," যোগ করেন নাজমুল হাসান।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "মহামারির সময়ে করোনা চিকিৎসায় রেমডেসিভির-এর ব্যবহার শুরু হয়। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে এই ওষুধ এক হাজার ডলারে বিক্রি হয়েছে। আমার কোম্পানি এই ওষুধ উৎপাদনের অনুমোদন নেয়। আর আমরা একই মান বজায় রেখে ওষুধটি দেশের বাজারে মাত্র ১০ ডলারে বিক্রি করেছি।"
অধিবেশনের মূল বক্তা ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির বলেন, "চীন, ভারত এবং পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়া আর কোনো দেশই ওষুধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো ভালো নয়। তাই বৈশ্বিক বাজারে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের সামনে একটি অসাধারণ সুযোগ রয়েছে।"
আবদুল মুক্তাদির বিএপিআই-এরও সহ-সভাপতি। তিনি বলেন, "এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমাদের বায়োসিমিলার, ভ্যাকসিন, অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) এবং গ্লোবাল জেনেরিক এক্সপোর্টে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।"
"গ্লোবাল জেনেরিক ওষুধের বাজার ৪০০ বিলিয়ন ডলার। এর ১ শতাংশ ধরতে পারলে আমাদের রপ্তানি দাঁড়াবে ৪ বিলিয়ন ডলার। আর ১০ শতাংশ ধরতে পারলে সেটি হবে ৪০ বিলিয়ন ডলার। আমাদের সে সামর্থ্য রয়েছে। কারণ আমাদের মতো কমপেটিটিভ এডভান্টেজ কেবল অল্প কয়েকটি দেশেরই আছে," যোগ করেন তিনি।
সিনোভেদা কানাডা ইনকর্পোরেটেডের প্রেসিডেন্ট ডা. ইয়াম কে ট্যাম, মেডট্রনিক বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের কান্ট্রি হেড দেবজ্যোতি ব্যানার্জি, নোভারটিস (বাংলাদেশ) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কান্ট্রি প্রেসিডেন্ট ডা. রিয়াদ মামুন প্রধান, নভো নরডিস্ক বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল ম্যানেজার রাজর্ষি দে সরকার এবং গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শনিবার উদ্বোধন হওয়া তিন দিনব্যাপী এই ব্যবসায়িক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)।