সুনীল অর্থনীতির বিকাশে বন্ডে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এডিবি, আইএফসি
বঙ্গোপসাগরের বিপুল সম্পদ আহরণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) বেসরকারিখাতের বন্ডে আগামী ১০ বছরে ন্যূনতম ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর উন্নয়নেও বিনিয়োগ করবে আন্তর্জাতিক সংস্থা দু'টি।
সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
বঙ্গোপসাগর-ভিত্তিক অর্থায়ন ছাড়াও সেবাখাতের বিভিন্ন প্রকল্প এবং সম্ভাবনাময় বেসরকারিখাতে বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে এ অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে সংস্থা দু'টি; যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে বলে মনে করছে কমিশন।
যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, বেসরকারি খাতের বন্ড ক্রয়ের মাধ্যমে তাদেরকে অর্থায়ন করবে আইএফসি ও এডিবি।
বন্ড হলো এক ধরনের ঋণ-ভিত্তিক সিকিউরিটিজ, যা ইস্যু করার মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান (এই ক্ষেত্রে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) বিনিয়োগকারীর থেকে অর্থ ধার করবে (এক্ষেত্রে আইএফসি ও এডিবির থেকে), এবং প্রতিশ্রুতি অনুসারে, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর সুদসহ আসল ফেরত দেবে।
বেসরকারি খাতের বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে আইএফসি এমন কোম্পানিগুলোকে পুঁজি সরবরাহ করছে – যাদের হয়তো প্রচলিত ব্যাংক ঋণ বা অর্থায়নের অন্যান্য উৎসে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা দেওয়া হবে।
বিএসইসি'র চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত- উল- ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সংস্থা দুটির আগ্রহ প্রকাশের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) আইএফসি'র সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে বিএসইসি।
এর আওতায়, বাংলাদেশের বিপুল সমুদ্রসীমার তলদেশ, পানিসম্পদ ও সি বেল্টে থাকা সম্পদ আহরণে বিনিয়োগ করা হবে বলে জানান তিনি।
'পাশাপাশি বন্ডগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে ছাড়া সম্ভব হয়, সেজন্যই আইএফসির সঙ্গে বৃহস্পতিবার ন্যাশনাল সাসটেইনিবিলিটি বন্ড গাইডলাইনস বিষয়ে কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট হয়েছে'।
শিবলী রুবাইয়াত- উল- ইসলাম এবং আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হল্টম্যান চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
সমঝোতা চুক্তির আওতায়, বাংলাদেশে লেবেলড বন্ড বাজার, যেমন – গ্রিন, সামাজিক, টেকসইতা, জলবায়ু ও ব্লু বন্ড – গড়ে তুলতে সহায়তা করবে আইএফসি।
বাংলাদেশে সাসটেইনিবিলিটি বন্ড সার্ভিস প্রোভাইডারদের সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করা ছাড়াও জাতীয় টেকসইতা বন্ড বিধিমালা (ন্যাশনাল সাসটেইনিবিলিটি বন্ড গাইডলাইন) বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে আইএফসি।
চুক্তি স্বাক্ষর শেষে মার্টিন হল্টম্যান বলেন, "জাতীয় টেকসইতা বন্ড বিধিমালা এদেশের সুনীল ও সবুজ অর্থনীতির জন্য অর্থ সংগ্রহে সাহায্য করবে। সুইস স্টেট সেক্রেটারিয়েট ফর ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের সাথে অংশীদারত্বে এদেশে পরিবেশগত, সামাজিক ও সুশাসনের (ইএসজি) চর্চা উন্নত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আইএফসি।"
সমুদ্র সম্পদ আহরণ, কার্বন নির্গমন প্রতিরোধ এবং জলবায়ু সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য গ্রিন বন্ড, ব্লু বন্ড ইস্যুর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ডেবট সিকিউরিটিজ বিধিমালায় বিশেষ বিধান যুক্ত করেছে বিএসইসি।
এডিবির সাথে চুক্তির বিষয়ে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
আইএফসি এবং এডিবি ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নতুন সিকিউরিটিজ চালুর বিষয়ে সহযোগিতা করছে বলে বিএসইসি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে জানিয়েছে।
পুঁজিবাজারে চলমান মন্দা পরিস্থিতিকে 'স্বাভাবিক' উল্লেখ করে বিএসইসি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বৃদ্ধি, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা এবং অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের কারণে পুঁজিবাজারে কিছুটা পতন দেখা যাচ্ছে।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে মামলায় জয়লাভের পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সমুদ্র সম্পদ আহরণ বিষয়ে কাজ শুরু করলেও এ বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। এমনকি গভীর সমুদ্রে যেখানে বড় আকৃতির সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়, সেখানে মাছ ধরার মতো কোন জাহাজ নেই বাংলাদেশের।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশীদ আলম বলেন, বিশ্বজুড়ে সমুদ্র সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত দেশগুলো আহরণ করতে পেরেছে মাত্র ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ।
বিনিয়োগকারীদের সাগরমুখী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে খুরশীদ আলম বলেন, সুনীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করলে সরকার ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে।
সাগরে বাংলাদেশের ভূমির পরিমাণ মূল ভূখন্ডের প্রায় ৮১ শতাংশের সমপরিমাণ। বঙ্গোপসাগরের বেইজ লাইন থেকে ২০০ মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক জোন। অর্থাৎ, এই বিপুল এলাকার পানি ও ভূমির সকল সম্পদের মালিক বাংলাদেশ। আর বেইজ লাইন থেকে ৩৫০ কিলোমিটার হলো মহীসোপানের সীমা বা গভীর সাগর।
বিএসইসির কর্মকর্তারা জানান, আইএফসি ও এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় নতুন সিকিউরিটিজ চালুর কাজ করছেন তারা।
ব্র্যাক ব্যাংকের প্রস্তাবিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়ের মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে আবাসন সুবিধা দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে ৬০০ কোটি টাকার বন্ডে বিনিয়োগ করেছে আইএফসি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও এ ধরণের বিনিয়োগ করেছে সংস্থাটি।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় ডেরিয়েভেটিভ, ইটিএফ, কমোডিটি ফিউচার্স-সহ বেশকিছু সিকিউরিটিজ চালু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিএসইসি।
এসব সংস্থার সহায়তায় ইতোমধ্যে অ্যাফর্ডেবল হাউজিং বন্ড, সাজেদা ফাউন্ডেশন বন্ড এবং গ্রিন সুকুক-সহ কিছু সিকিউরিটিজ চালু হয়েছে।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অরেঞ্জ এবং ক্ষুদ্র এবং অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য পিংক বন্ড চালুর পরিকল্পনাও করছে কমিশন।
এছাড়া, আবাসন খাতের উন্নয়নের জন্য রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (আরইআইটি) এর মাধ্যমে যাতে উদ্যোক্তাদের মূলধন সরবরাহ করা যায়, সেজন্য বিএসইসিকে সহায়তা করছে সংস্থাগুলো।