বিশ্বব্যাংক, জাইকার ৩.৩ বিলিয়ন ডলার পেতে ৮ প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত করার উদ্যোগ সরকারের
প্রক্রিয়াধীন থাকা বিদেশি সহায়তা ব্যবহার করতে না পারা বাংলাদেশের একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা, যা সমাধানে অবশেষে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। একারণে দীর্ঘদিন অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আটকে থাকা প্রকল্পগুলোকে দ্রুততর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সহায়তা প্যাকেজগুলো অনুমোদন দেয় বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। তবে সুষ্ঠুভাবে ও স্বচ্ছতার সাথে এসব তহবিলের ব্যবহার নিশ্চিত করতে কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহির শর্ত থাকায়– বাংলাদেশ এসব তহবিল ব্যবহার করতে পারেনি।
প্রক্রিয়াধীন বা পাইপলাইনে থাকার অর্থ উন্নয়ন সহযোগীরা প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দিয়েছে, তবে তহবিল ছাড় করেনি বা তা পুরোপুরি ব্যবহৃত হয়নি। প্রকল্প অনুমোদন বা বাস্তবায়নে বিলম্ব; তদারকি নিশ্চিতে বিভিন্ন প্রতিকূলতা; বা আমলাতান্ত্রিক সমস্যার মতো নানান কারণে এমনটা হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে সরকার উদ্যোগী হয়েছে। এর আওতায়, সোমবার (২৭ মার্চ) একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আহ্বান করেছে পরিকল্পনা কমিশন। ৩.৩ বিলিয়ন ডলার রেয়াতি ঋণ থাকা আট প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া কীভাবে দ্রুততর করা যায়– এটাই হবে সভার মূল বিষয়বস্তু।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে দেশ যখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে, সেই সংকটময় সময়েই এলো সরকারের এই উদ্যোগ।
পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিত কর্মকার জানান, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাইপলাইনে থাকা প্রকল্পের সংখ্যা পাঁচটি। এগুলোর আওতায় দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ।
"এরমধ্যে একটি প্রকল্প ইতোমধ্যেই একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী এক/ দুই মাসের মধ্যে বাকী ৪ প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দ্রুত প্রকল্প প্রস্তাব পুনর্গঠনের কাজ দ্রুত শেষ করতে বলা হয়েছে," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে যে পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে - 'হায়ার এডুকেশন অ্যাক্সিলারেশন ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট'। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পটির জন্য ১৯১ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে বৈশ্বিক দাতা সংস্থাটি। তবে, অনুমোদনের পর দুই বছর পেরোলেও বাংলাদেশ এই ঋণ ব্যবহার করতে পারেনি।
ঋণ ব্যবহারে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশকে ১৮ মাস সময় দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক, তবে সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে আরো তিন মাস সময় বাড়ানোর অনুরোধ করেছে।
অতীতের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশে যখন জরুরি ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রার দরকার, তারমধ্যেই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নকৃত আরো চারটি প্রকল্পের ঋণও ব্যবহার করতে পারেনি বাংলাদেশ।
'দেরির কারণে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে'
বৈদেশিক ঋণের প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত না হওয়াকে 'হতাশাজনক' বলেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
তিনি উল্লেখ করেন, এতদিন প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদার নিয়োগে দুই-এক বছর দেরি হতো। এখন ঋণ চুক্তি করতেই দুই বছর পার হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীরা অনুমোদন দেওয়ার দেওয়ার পর, নির্ধারিত সময়েও চুক্তি করতে না পারার জন্য বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্বব্যাংক তিন বছরের আইডিএ- প্যাকেজ ঋণ দিয়ে থাকে। প্যাকেজে আইডিএ দেশগুলোর জন্য বরাদ্দও ঘোষণা করা থাকে। প্রথম বছরে যদি বরাদ্দের মূল অংশ পাওয়া যায়, তাহলে শেষের দিকে বরাদ্দের চেয়ে বেশি ঋণ পাওয়ার সুযোগ থাকে। কারণ দেখা যায়, অনেক দেশ তাদের জন্য নির্ধারণ করা ঋণের পুরোটা ব্যবহার করতে পারে।
দ্রুত প্রকল্প অনুমোদন চায় জাইকা
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী এবং সকল দাতাসংস্থার মধ্যে তৃতীয় বৃহৎ ঋণদাতা – তাদের অর্থায়নের আওতায় থাকা নতুন এবং সংশোধিত প্রকল্পগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সরকারকে অনুরোধ করেছে।
এনিয়ে কথা বলতে চলতি মাসেই পরিকল্পনা কমিশনে যান জাইকার বাংলাদেশ অফিসের প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তমোহিদে এবং পরিকল্পনা-সচিবকে একটি তালিকাও দেন।
২০২২ সালের জুন নাগাদ বাংলাদেশকে দেওয়া জাইকার মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ বিলিয়ন ডলার।
ভাসমান সুদহারের ঋণ বর্জন করবে সরকার
দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশের কাছে আউটস্ট্যান্ডিং ঋণের পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ডলার, ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিয়ে তারপরেই আছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভাসমান সুদহার বর্তমানে উচ্চ অবস্থানে রয়েছে। বিশেষত, ছয় মাসের এসওএফআর সুদহার ৪ শতাংশের বেশি।
তাই সরকার ভাসমান সুদহারে ঋণ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় সরকার নির্ধারিত সুদহারের নমনীয় ঋণও নিতে পারছে না। এই দেরি উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতিতেও প্রভাব ফেলছে।
ইআরডি'র তথ্যমতে, বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এই অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি মেয়াদে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৩.১৯ শতাংশ কমে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
ইআরডির কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি নমনীয় ঋণ পায় বিশ্বব্যাংক ও জাইকার থেকে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি এই নমনীয় ঋণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। "এরপরও আমরা নির্ধারিত সময়ে ঋণ নিতে পারছি না।"
অনুমোদনে দেরির প্রধান কারণ
পরিকল্পনা কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্প প্রস্তাব পাওয়ার ৫৫ দিনের মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু, প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই সঠিকভাবে না করায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো পুনর্গঠিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে পারেনি। এসব কারণে প্রকল্পগুলো তিন বছর পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের আওতায় থাকা প্রকল্প
'হায়ার এডুকেশন অ্যাক্সিলারেশন ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট' এর জন্য ১৯১ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর বাইরে 'সড়ক নিরাপত্তা' প্রকল্পের জন্য ৩৫৮ মিলিয়ন; 'অ্যাক্সিলারেটিং ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেড কানেকটিভিটি ইন ইস্টার্ন সাউথ এশিয়া- বাংলাদেশ ফেইজ-১' প্রকল্পের জন্য ৭৫৩.৪৫ মিলিয়ন; এবং 'অভিযোজন এবং দুর্বলতা হ্রাসের জন্য স্থিতিস্থাপক পরিকাঠামো' প্রকল্পে ২৫০ কোটি ডলার অনুমোদন দিয়েছে।
২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়। এরমধ্যে শুধু 'অভিযোজন এবং দুর্বলতা হ্রাসের জন্য স্থিতিস্থাপক পরিকাঠামো' প্রকল্প চলতি মাসের শুরুতে একনেকে অনুমোদন পায়।
জাইকার অর্থায়নের প্রকল্পগুলো
জাইকা-অর্থায়নকৃত তিনটি প্রকল্পের ঋণ চুক্তি এই মাসে স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু, ১.৩ বিলিয়ন ঋণের এ প্রকল্পগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া এখনও সম্পন্ন হয়নি।
প্রকল্পগুলো হলো- 'মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন', 'চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন' এবং জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদীর মধ্যে ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ।
৪৩তম ঋণ প্যাকেজের অধীনে, কক্সবাজারের মহেশখালিতে 'মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন' প্রকল্পে ৮০০.৭৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে জাইকা।
প্রকল্পটি কনটেইনার এবং সাধারণ কার্গোর জন্য একটি বহুমুখী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতাকে শক্তিশালী করবে। এটি অভ্যন্তরীণভাবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে পণ্যের প্রবাহ বাড়াতে সহায়তা করবে।
জাইকার অর্থায়নে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের জন্য চারটি আউটার হাইওয়ে এবং একটি এলিভেটেড বাইপাস নির্মাণ করতে যাচ্ছে, যার লক্ষ্য এই রুটে মসৃণ ও যানজটমুক্ত যান চলাচল নিশ্চিতকরণ এবং মাতারবাড়ী বন্দরে পণ্যবাহী যান চলাচল ব্যবস্থার উন্নতি।
৪৩তম ঋণ প্যাকেজের আওতায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পরিবহন প্রকল্পে ৪২৩.৫৪ মিলিয়ন ডলার দেবে জাপান।
চীন প্রকল্পের মাঝপথে পিছিয়ে যাওয়ায় জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ রেললাইন প্রকল্পের জরিপ ও নকশায় অর্থায়ন করছে জাপান। জাপানি উন্নয়ন সহযোগীটি মূল নির্মাণ কাজের জন্য অর্থায়ন করতে সম্মত হয়েছে। এজন্য তারা ৩২.১৩ মিলিয়ন ডলার দেবে।