আগামী বাজেটে ভর্তুকি বাড়বে ৩৫ শতাংশ
ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর শর্তানুসারে, দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ৩৫ শতাংশ বরাদ্দ বাড়াতে হতে পারে সরকারকে।
একইসঙ্গে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, লাইবর রেট বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সুদহার বৃদ্ধি এবং ট্রেজারি বন্ডে সুদের হার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে – অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে আগামী অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ (চলতি অর্থবছরের তুলনায়) ২৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থমন্ত্রণালয়ের নথিতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ আছে ৮১,৪৯০ কোটি টাকা; ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে তা ১,১০,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অবশ্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষি, বিদ্যুৎ ও খাদ্য সহায়তা বাবদ ভর্তুকিতে বাড়তি ১৬,৮১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে অর্থ বিভাগ।
অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরের সুদ পরিশোধে ৭৯,৫৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। নতুন অর্থবছর এটি বেড়ে এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
অর্থাৎ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৩৫,৬৯১ কোটি টাকার তুলনায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সুদ পরিশোধের ব্যয় তিনগুণ বাড়বে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ৬৮,২১৩ কোটি টাকা।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, চলতি অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার ১৩.৫% বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ মাত্র ৬ শতাংশ বা ১৪,০০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১,৪৬,১০০ কোটি টাকা করা হবে।
সুদ ব্যয় ও ভর্তুকির চাপ সামলাতে নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১.৫ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এবারের চেয়ে এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ছে মাত্র ৬%।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার বেড়ে হবে প্রায় ৭,৬৯,০০০ কোটি টাকা। বাজেটের আকার প্রায় ৯০,০০০ কোটি টাকা বাড়লেও, অর্থ বিভাগের প্রাক্কলন অনুসারে, তার প্রায় ৫৭,০০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে সুদ পরিশোধ এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ।
আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে অর্থবিভাগের এই প্রাক্কলন ২ এপ্রিল অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য বাজেট প্রাক্কলন পরীক্ষা সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হবে।
ওই সভায় অনুমোদনের পর, আগামী ৫ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। পরে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় তা চূড়ান্ত করে ১ মে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হতে পারে।
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেছেন, আইএমএফ এর শর্তানুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও নির্বাচনী বছরে দাম খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। আইএমএফ এর পক্ষ থেকে এ দুইখাতে ভর্তুকি কমানোর শর্ত দেওয়া হয়েছে। সেটি মাথায় রেখেই নির্বাচনী বছরে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভর্তুকিতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম কমে যুদ্ধপূর্ব পর্যায়ে গেলেও, তা প্রাক-মহামারি পর্যায়ে পৌঁছাতে আরও সময় লাগবে।
এদিকে দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনৈতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানোর সুপারিশ করেছে।
সংস্থাটি গতকাল বলেছে, আগামী জুলাই মাস থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন এবং প্রতিমাসে একবার করে এটি সমন্বয় করতে হবে।
সিপিডির রিসার্চ ফেলো গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, বিদ্যুৎখাতে সরকারের যে ভর্তুকি, তা দিতে হচ্ছে 'ওভার ক্যাপাসিটির' কারণে। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে 'নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পে' পদ্ধতিতে যাওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বাজার দরে এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ায় এখাতেও ভর্তুকি বাড়ার আশঙ্কা করে সিপিডি বলেছে, স্থানীয়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। একইসঙ্গে, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎপাদনেও তা দিতে হবে। শেষপর্যন্ত যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ভর্তুকির বোঝামুক্ত হতে সহায়তা করবে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা খুবেই চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদও।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "গতবার বাজেট প্রণয়নের সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি খুব একটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি এবং তখন আইএমএফ'র দিক থেকেও কোন শর্ত ছিল না। তাই গতবারের ফর্মুলায় এবারের বাজেট প্রণয়ন করা যাবে না।"
তিনি বলেন, গতবছর ভর্তুকি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল। কিন্তু এবার ভর্তুকির লাগামও টেনে ধরতে হবে, আবার মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ব্যয় বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও বিবেচনায় নিতে হবে।
"সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় বাড়াতে হলে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। কিন্তু আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব কমে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কর থেকে আয় বাড়াতে হবে, কিন্তু চাইলেই এটা বাড়ানো সম্ভব নয়"- জানান তিনি।
মুদ্রার বিনিময় দরের সাথে মূল্যস্ফীতির রেটের বিরাট সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে মাহবুব বলেন, "তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ডলারের বিপরীতে টাকার মান শক্তিশালী করতে হবে। এজন্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সরকারের আয় বাড়াতে নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বাড়াতে হবে।"
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভর্তুকি কমানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আয় বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল নীতি। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য আইএমএফও এসব বিষয়ে শর্তারোপ করে।