২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় বাড়বে ১,৫০০ কোটি টাকা
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নতুন করে ৭.৩৫ লাখ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া, প্রায় এক দশক পর আগামী অর্থবছর বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে– সাম্প্রতিক সময়ে পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে।
সোমবার (৩ এপ্রিল) সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় এক সভায় এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয় – ফলে নতুন অর্থবছরে এখাতে অতিরিক্ত ১,৫২৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন বিবেচনায় সভায় অংশ নেওয়া প্রতিটি মন্ত্রণালয় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগী বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।
সভায় উপস্থাপন করা নথি অনুযায়ী– বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি এবং প্রতিবন্ধী ভাতা – সকল কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ২৩,৭৪,০০০ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তাতে সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছর ব্যয় বৃদ্ধি পেত ৩,৪৪৫ কোটি টাকা।
তবে উপকারভোগীর সংখ্যা এবং সব ক্যাটাগরিতে ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দেন অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য তুলে ধরে সভায় অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। এ অবস্থায় সকল ক্যাটাগরিতে উপকারভোগী বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হবে না।
অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-কে জানান, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে যে ৭.৩৫ লাখ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসবে, তার মধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়বে ৫.৩৫ লাখ। এছাড়া, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে এক লাখ করে।
একইসঙ্গে বয়স্ক ভাতার উপকারভোগীদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
এপ্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ১ লাখ কোটি টাকার বেশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে এক কোটির বেশি মানুষকে দেয়া হচ্ছে মাত্র ৯,০০০ কোটি টাকা। এই অসামঞ্জস্য দূর করতে এ খাতের সব কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
তারা বলেন, পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনধারণে সহায়তার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেয়া হলে মাসে ৫০০-৬০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হত না। বর্তমান বাজারে এই পরিমাণ টাকা দিয়ে একজন মানুষের প্রয়োজনীয় কোনো পণ্য কেনা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন তারা।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এরমধ্যে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি এবং প্রতিবন্ধী ভাতা-প্রাপ্ত ১০,৬৪,১০০০ জন বছরে মোট ভাতা পান ৭,৪৬৫ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ অর্থের বড় অংশই ব্যয় হয় সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, সরকার পরিচালিত বিভিন্ন তহবিল এবং সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণসহ ছোট-খাট বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আগামী অর্থবছর থেকে পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ ব্যয়ের অর্থ– এখাতে বরাদ্দ না দেখানোর পরামর্শ দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশের বেশি, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া, উচ্চ ভর্তুকির চাপ কমাতে ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার কয়েক দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে বাজারে খাদ্যপণ্যের দামও অনেক বেড়ে গেছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ২৫ শতাংশ এবং চার সদস্যের একটি পরিবারের মাছ-মাংস ছাড়া মাসিক খাদ্য ব্যয় ৭,০০০ টাকার বেশি।
অপর একটি গবেষণা সংস্থা- সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এর তথ্যমতে, মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ তিনবেলা খেতে পারছে না।
এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতাধীন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলো – বেষ্টনীর আওতা ও ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করলেও – দারিদ্র কমার তথ্য তুলে ধরে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়।
এমনকী আগামীতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি প্রত্যাহারের সুপারিশের সঙ্গে আইএমএফ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী শক্তিশালী করার পরামর্শ দিলেও – আগামী বাজেটে এখাতে বড় ধরণের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না বলে জানান সভায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা।
দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, অতি-দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে তার মন্ত্রণালয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এখাতে বরাদ্দ ছিল ১৬,৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ৫০০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিবেচনায় নতুন অর্থবছরে বাড়তি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এবার বাড়তি বরাদ্দ পাওয়ার আশাই করেছিল দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
অর্থনীতিবিদরা কী বলছেন?
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, কোভিডের অভিঘাত থেকে বের হয়ে আসার আগেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অনেকের আর্থিক সঙ্গতি কমেছে। এ হিসেবে আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগী ব্যাপক হারে বাড়বে বলে প্রত্যাশা ছিল।
তাছাড়া সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেকটা কমে গেছে। এ বিবেচনায়ও সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাভোগীদের মাসে অন্তত ১,০০০ টাকা করে দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'এটা ঠিক যে সরকার কিছুটা আর্থিক চাপে রয়েছে। তবে দরিদ্র মানুষের জীবনধারণ সহজ করতে সরকারকে একটু বাড়তি চাপ নিতে হবে'। এক্ষেত্রে সরকারের অগ্রাধিকারে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, 'সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আকার বৃদ্ধির পাশাপাশি এ খাতে দরিদ্রদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ বৃদ্ধির তাগিদ দেয়া হলেও– নতুন বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না'। বর্তমান বাজার দর বিবেচনায় রেখে দরিদ্রদের জন্য ভাতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তিনি।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে যা ছিল
বর্তমানে এক লাখ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী প্রতি মাসে উপবৃত্তি পায়। প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা মাসে ৭৫০ টাকা, মাধ্যমিকে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিকে ৯০০ টাকা এবং উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা মাসে ১,৩০ টাকা হারে বৃত্তি পান। এতে এবছর সরকারের ব্যয় হবে 95.64 কোটি টাকা। এতে এবছর সরকারের ব্যয় হবে ৯৫.৬৪ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মাসে ১, ১০০ টাকা, মাধ্যমিকে ১,৩০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিকে ১,৪০০ টাকা এবং উচ্চতর পর্যায়ে ১,৬০০ টাকা প্রস্তাব করেছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হতো ৪৮.৮৯ কোটি টাকা।
কিন্তু, এ প্রস্তাবে সায় না দিয়ে চলতি অর্থবছরের মতোই আগামী অর্থবছর বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে অর্থবিভাগ।
সরকার প্রতিবন্ধীদের মাসে ৮৫০ টাকা হারে ভাতা দেয়। চলতি অর্থবছর ২৩.৬৫ লাখ প্রতিবন্ধীকে এ সুবিধা দিতে বরাদ্দ রয়েছে ২,৪২৯.১৮ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব উপকারভোগীর সংখ্যা ৫.৩৫ লাখ বাড়ানোর পাশাপাশি মাসিক ভাতার পরিমাণ ১,০০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ প্রস্তাব অনুযায়ী উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়াতে সম্মতি দিলেও, ভাতার হার বাড়াতে রাজি হয়নি। ফলে নতুন অর্থবছর এখাতে বাড়তি ব্যয় হবে ৫৪৯.৫৩ কোটি টাকা।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সবচেয়ে বেশি মানুষ সুবিধা পান বয়স্ক ভাতার আওতায়। চলতি অর্থবছরে ৫৭.১০ লাখ বয়স্ক নাগরিক প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। এতে চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হবে ৩,৪৪৪.৫৪ কোটি টাকা।
২০১৬-১৭ অর্থবছর বয়স্কদের ভাতার পরিমাণ ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়। তারপর সাত বছর কেটে গেলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে বয়স্কদের ভাতার হার বাড়ানো হয়নি।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে বয়স্ক ভাতার পরিমাণ ৬০০ টাকা নির্ধারণসহ ১১.৪৯ লাখ উপকারভোগী যোগ করার প্রস্তাব করেছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে অতিরিক্ত ১,৫২২ কোটি টাকা ব্যয় হতো।
অর্থ মন্ত্রণালয় বয়স্ক ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা এক লাখ বাড়ানোর পাশাপাশি ভাতার হার ৬০০ টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে বয়স্ক ভাতায় নতুন অর্থবছরে অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৭৬১.৪২ কোটি টাকা।
এছাড়া, বর্তমানে ২৪.৭৫ লাখ বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মাসে ৫০০ টাকা হারে ভাতা পান। এতে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ আছে ১,৪৯৫.৪০ কোটি টাকা। ভাতার এই হারও সাত বছর আগে নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা আর বাড়েনি। এবার ভাতার হার ৬০০ টাকা নির্ধারণসহ উপকারভোগীর সংখ্যা ৬.৯০ লাখ বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের।
তবে অর্থবিভাগ ভাতার হার মাসে ৫০ টাকা এবং উপকারভোগীর সংখ্যা এক লাখ বাড়ানো হবে বলে মত দিয়েছে। এতে বাড়তি ব্যয় হবে ২১৬ কোটি টাকা।