রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার নির্দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে ১০ শতাংশের নিচে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এই শর্ত পরিপালন করা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক।
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের এমডির সঙ্গে বৈঠকে এই নির্দেশ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
সভায় গভর্নরের সভাপতিত্বে আরও উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক এবং স্ব স্ব ব্যাংকের ব্যবসস্থাপনা পরিচালকগণ।
বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা হিসেবে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার পেতে ব্যাংকিং খাতে কিছু সংস্কারের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ।
এরমধ্যে আছে- ঋণের ক্ষেত্রে সুদের সর্বোচ্চ হারের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার, বৈদেশিক মুদ্রার নেট রিজার্ভের পরিমাণ প্রকাশ, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হ্রাস ও মুদ্রাবাজারের ওঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ ইত্যাদি। শর্ত অনুযায়ী সংস্কার শুরু হয়ে গেছে। আর ইতিমধ্যেই ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় করেছে আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৫ কোটি টাকার, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এছাড়া এক হাজার ৮৩২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। তাই আগামী জুন মাসের মধ্যে যেকোনো মূল্যে খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামানো ও মূলধন ভিত্তি আরও শক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর।
রাষ্ট্রায়ত্ত অপর ব্যাংক রূপালী-র বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৬৩১ কোটি, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আলোচ্য সময় শেষে ২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার প্রভিশন ও ২ হাজার ১০৭ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকটি।
এসময়ে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০২২ শেষে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি।
এদিকে অগ্রণী ব্যাংকের ২২ দশমিক ৩১ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আইএমএফর শর্ত পরিপালন করতে হলে ব্যাংকটিকে আরও ১২ শতাংশ খেলাপি কমাতে হবে।
২০২২ সাল শেষে ৬৬ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে অগ্রণী ব্যাংক। এরমধ্যে ১৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। আলোচ্য সময় শেষে ৪ হাজার ৪২২ কোটি টাকার পভিশন ঘাটতি ও ৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে অগ্রণী।
এছাড়াও ব্যাংক চারটির বেশিরভাগ ঋণ মাত্র পাঁচ শাখার মধ্যে পুঞ্জিভূত। এসব ঋণের বিস্তৃতি ও আদায় বৃদ্ধির তাগিদ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। অবলোপন, খেলাপি ও অর্থঋণ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া জোরদারেরও নির্দেশ দেওয়া হয় বৈঠকে।
প্রসঙ্গত, আইএমএফ যেসব সংস্কার কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেওয়ার সুপারিশ করেছে সেগুলো হলো, কর্পোরেট সুশাসন আরও বলিষ্ঠ করা, বর্তমান অবকাঠামোর ওপর তদারকি আরও কঠোর করা ও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ঋণদাতাদের অধিকার প্রয়োগের জন্য আরও বলিষ্ঠ সহযোগিতা ও ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের জন্য প্রণোদনা নিশ্চিতে আইনি ব্যবস্থার যথোপযুক্ত সংস্কার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। ৩ মাস পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে সেটা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।
আগের বছরের, অর্থাৎ ২০২১ সালের অক্টোবর–ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে অবশ্য এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ৩৮৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খেলাপি ঋণ শুধু বেড়েছে। এবার তিন মাসের হিসাবে সেটা কমলো।
বর্তমানে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকের মতো প্রায় সমপরিমাণ ৫৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এক্ষেত্রে তেমন পিছিয়ে নেই।
এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।