ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চাপের মুখে বাংলাদেশের নন-আরএমজি রপ্তানি খাত
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের নন-আরএমজি পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন শিল্প নেতারা।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ সমন্বয় করতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। তাছাড়া, পাটজাত পণ্য এবং হিমায়িত ও জীবন্ত মাছের ব্যবসাকে প্রভাবিত করছে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি এক বছরে ৮.০৭% বেড়ে ৪১.৭২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে, এই প্রবৃদ্ধি মূলত তৈরি পোশাক খাতের কারণে হয়েছে। উক্ত সময়ের মধ্যে ১২.১৭% প্রবৃদ্ধি হয়ে এই খাতের আকার দাঁড়িয়েছে ৩৮.২৫ বিলিয়ন ডলারে।
এই বছরের মার্চে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি ২.৪১% কমে ৪.৭৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে এসময় গার্মেন্টস খাতের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, যা বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে বরাবরই একটি নির্ভরের জায়গা হিসেবে কাজ করে আসছে।
তৈরি পোশাক ও চামড়া খাত ব্যতীত সমস্ত প্রধান রপ্তানি খাত চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। হোম টেক্সটাইল ২৫.৭৩%, পাট ও পাটজাত পণ্য ২১.২৩%, কৃষি পণ্য ২৮.৩১% এবং প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি ৩৩.৬৫% কমেছে।
অপরদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ২.৫৬% বেড়েছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রধান বাজারগুলোতে বেশ কয়েকটি হোম টেক্সটাইল স্টোর বন্ধ হয়ে গেছে, যাতে প্রভাবিত হয়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি।
তিনি যোগ করেন, অ্যাপারেলের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের তৃতীয় বিকল্প হলো হোম টেক্সটাইল। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে কেউ সেগুলো কিনবে না।
মমটেক্স এক্সপো লিমিটেডের ব্যবসায়িক প্রধান জোসেফ চৌধুরীও বলেন, যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি ব্যবসায় প্রভাব ফেলেছে, কারণ হোম টেক্সটাইল কেউ কিনছে না।
গ্রাহকের অভাবের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অনেক স্টোর এরমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে বাংলাদেশও আগের বছরের মতো অর্ডার পাচ্ছে না, বলেন তিনি।
এদিকে, সাম্প্রতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে ফার্মের খরচ ৫%-৮% বেড়েছে।
হোম টেক্সটাইল সেগমেন্টের অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী পাকিস্তান। জোসেফ বলেন, মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের তুলনায় প্রায় ৩০% কম দাম অফার করতে পারছে তারা। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা তাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জোসেফ জানান, মোমটেক্স এক্সপো লিমিটেডের বিক্রয় গত কয়েক মাসে প্রায় ৫০% কমেছে, কিন্তু মাসে তিন মিলিয়ন মিটার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের এক শীর্ষস্থানীয় হোম টেক্সটাইল রপ্তানিকারক বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির কারণে গ্রাহকরা তাদের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছেন।
জ্বালানির দাম স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বাজারের উন্নতি নাও হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত গ্রাহকদের কেউই আশঙ্কা থেকে মুক্ত হবে না।"
পাট ও পাটজাত পণ্য
গত অর্থবছরে বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় ছাড়ায় একসময়ের সমৃদ্ধ পাট শিল্প। কিন্তু এই অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১% কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই খাতে।
কাঁচামালের উচ্চমূল্যকে আয় কমে আসার কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন দেশের অন্যতম বৃহৎ পাটপণ্য রপ্তানিকারক আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন।
তিনি বলেন, গতবছর একদল অবৈধ মজুতদার কাঁচা পাটের দাম বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে দুই বা আড়াই হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা দাম উঠে প্রতি মণ (প্রায় ৩৭ কেজি) পাটের।
এই সিন্ডিকেটের ফলে, তুরস্কের বেশ কিছু আমদানিকারক তাদের কার্পেটে পাটের সুতার পরিবর্তে পুনর্ব্যবহৃত পোশাকের সুতা ব্যবহার শুরু করে, যার বাংলাদেশের পাটের বাজারের ওপর প্রভাব ফেলে। পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি খাতে তুরস্ক দেশের বৃহত্তম বাজার।
শেখ নাসির উদ্দিন বলেন, ব্যবসার উন্নতির জন্য এখনও আলোচনা চলছে। রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য ও বাজারে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করছে।
চলতি বছরের মার্চে ব্যবসায় কিছুটা প্রবৃদ্ধি দেখা গেলেও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করতে কাঁচামালের স্থিতিশীল মূল্যের ওপর জোর দেন তিনি।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য
প্রথম নয় মাসে চামড়াজাত পণ্য এবং পাদুকা খাতে কিছুটা বৃদ্ধি দেখা গেলেও, চামড়া রপ্তানিতে প্রায় ২০% নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, যেখানে চামড়ার পাদুকাতে প্রায় ১% নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। তবে বছরে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে এ খাতের ঘাটতি পূরণ হয়েছে।
বাংলাদেশ লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাত ভাল অবস্থায় ছিল। মূলত পাঁচ থেকে ছয় মাস বা তারও আগেই অর্ডার বুক করা ছিল বিধায় এ খাতের অবস্থা ইতিবাচক ছিল।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জানুয়ারি থেকে রপ্তানি কমে আসার পূর্বাভাস দেখা দেয় এ খাতে। তাছাড়া, করোনায় গ্রাহকদের কেনাকাটার ধরনেও এসেছে পরিবর্তন। পণ্য কেনা কমিয়ে তারা এখন রেস্টুরেন্টে বেশি সময় দিচ্ছে।
গত বছর বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড পরিমাণ চামড়াজাত পণ্য আমদানি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে বিশাল ইনভেন্টরি থাকলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সুদহারের কারণে বিক্রি কমে যাচ্ছে। এর ফলে অনেক খুচরা বিক্রেতা নতুন অর্ডার দেওয়ার আগে তাদের ইনভেন্টরির দিকটা বিবেচনা করছেন বলে জানান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও, জাপানের বাজার ভাল পারফর্ম করছে, তিনি বলেন।
চার্টার ডট কো-এর মতে, নাইকি এবং অ্যাডিডাসের প্রচুর পরিমাণে অবিক্রিত ইনভেন্টরি রয়েছে। তাদের মধ্যে নাইকির রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিকে তাদের বিক্রি ১৪% বেড়ে ১২.৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, তাদের রেকর্ড পরিমাণ স্টক আছে বলেও জানিয়েছে কোম্পানিটি।
অন্যদিকে, ইনভেন্টরি সমস্যা নিয়ে কঠিন সময় পার করছে অ্যাডিডাসও। গত তিন দশকের মধ্যে এ বছরই প্রথমবারের মতো জার্মান কোম্পানিটি ক্ষতির মুখ দেখতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নাসিম মঞ্জুর বলেন, আগামী জুনের মধ্যে এ খাতে সামান্য পরিমাণে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিতে পারে। তবে তিনি একথা স্বীকার করেন যে, খাতটি বর্তমানে বেশ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।
ঢাকা ইপিজেড-ভিত্তিক রপ্তানিমুখী ফিনিশড চামড়া প্রস্তুতকারক অস্টান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল ওয়ারা পরামর্শ দিয়ে বলেন, ট্যানারিতে এনভায়রনমেন্টাল কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার মাধ্যমে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার মাধ্যমে খাতটির উন্নতি সাধন করা যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি কমাতে ইউরোপের বাজারের ওপর নির্ভরতা কমানোরও সুপারিশ করেন তিনি। ইবনুল ওয়ারা আরও বলেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার বাজার বাড়ানোর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ রপ্তানি
হিমায়িত এবং জীবন্ত মাছ রপ্তানিখাতে প্রধান পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় চিংড়ি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির কারণে, রপ্তানি চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময় থেকে প্রায় ২৫% নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে এ খাতে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, চিংড়ি সব সময়ই বিলাসবহুল খাবার হিসেবে বিবেচিত। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিচ্ছেন না, আবার কিছুক্ষেত্রে অর্ডার পিছিয়েও নিচ্ছেন।
অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যবসা ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসতে পারবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি,
সোবি ফিশ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, করোনার সময়েও এ খাত এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়নি।
রপ্তানিকারকরা আরো বলেন, বছরের পর বছর ধরে চিংড়ি চাষ কমেছে। তাছাড়া স্থানীয় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে কাঁচামালের উৎসও কমে যাচ্ছে।
কৃষিপণ্য
কৃষিপণ্য রপ্তানি ২০২১ ও ২০২২ দুই অর্থবছরেই ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। মহামারি চলাকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়াজাত খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া এ প্রবৃদ্ধির প্রধান কারণ।
কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে এ খাতের রপ্তানি প্রাপ্তি ২৮% কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮৭.০৯ মিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৯৫৮.৪৫ মিলিয়ন ডলার।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "একটি কোম্পানি হিসেবে আমরা ভালো অবস্থানে আছি, যদিও সামগ্রিক শিল্পের অবস্থা ভালো না। তবে প্রবৃদ্ধি আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি।"
কিছু অভ্যন্তরীণ কারণে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকরা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগীতা হারাচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্থরতা চলতে থাকায় ক্রেতারা ব্যয়ের বিষয়ে এখন আরও বেশি সতর্ক। এতে তাদের ক্রয়েও এসেছে পরিবর্তন।
বাইসাইকেল
বাইসাইকেল রপ্তানি চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে ৯.১৩% কমে ১১১.১৪ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগের একই সময়ে ১২২.৩১ মিলিয়ন ডলার ছিল।
দেশে সাইকেল রপ্তানিতে শীর্ষস্থানীয় মেঘনা গ্রুপের অপারেশন ডিরেক্টর মো. লুৎফুল বারি বলেন, "করোনার তুলনায় সাইকেল রপ্তানি বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।"
বাংলাদেশ বাইসাইকেল অ্যান্ড পার্টস ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব বারি আরো বলেন, গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি ও এর মূল্যবৃদ্ধিতে সাইকেল রপ্তানিকারকরাও প্রভাবিত হয়েছে।