সারের দামবৃদ্ধি: ভর্তুকির টাকা যোগানে চাপ পড়লো কৃষকের ঘাড়ে
সারে অতিরিক্ত ভর্তুকির চাপ সামাল দিতে নয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার কৃষক পর্যায়ে সারের দাম বাড়ালো সরকার। এবারে ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সারের দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এই দাম বৃদ্ধির কারণে বছরে সারের পেছনে ভর্তুকি ব্যয় বাবদ সরকারের প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে, যে টাকাটা আসবে কৃষকের পকেট থেকে।
অথচ মাত্র সাত দিন আগেও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক সচিবালয়ে সার নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে দাবি করেন, 'সারের দাম বাড়ানো হবে না। আসন্ন অর্থবছরেও (২০২৩-২৪) সারের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।'
সারাদেশে বোরো মৌসুমের ধান চাষ চলছে, যা চাল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় মৌসুম এবং এই মৌসুমের উৎপাদনের উপর দেশে সারা বছরের চালের বাজারের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। কৃষক ও কৃষি গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ স্থানেই বোরো ফসল ধান গঠনের পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে খুব বেশি সারের ব্যবহার নেই। ফলে এই মৌসুমে কৃষকের উপর চাপ না বাড়লেও ভু্ট্টা, সবজি সহ মাঠে অন্য যেসব ফসল রয়েছে সেখানে খরচের চাপ বাড়বে।
এই মুহূর্তে সারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব না পড়লেও পরবর্তী সব মৌসুমেই এই বাড়তি খরচ কৃষকের ঘাড়ে চাপবে, যা কৃষককে উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মোঃ শাহজাহান কবীর টিবিএসকে বলেন, 'জাতের ধরন অনুযায়ী বোরো মৌসুমে বিঘাপ্রতি ৩৫-৪০ কেজি ইউরিয়া, ১৩ কেজি টিএসপি, এমওপি ২২ কেজি ও ১২ কেজি ডিএপি দরকার হয়। তবে ধান এখন যে পর্যায়ে আছে সেখানে আর সারের দরকার নেই।'
সারের দাম বাড়ানোর পর কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের নির্দেশনায় কৃষি মন্ত্রণালয় সারের মূল্য বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। এতে বলা হয়, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং গুণগত ব্যবহার নিশ্চিতে সারের মূল্য পুনঃনির্ধারণ করা হলো।
অথচ কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যই বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে এক কেজি ইউরিয়াতে ৭৪ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে আসা এবং বর্তমানে দেশে দাম বাড়ানোর পর সরকারের ভর্তুকি নেমে এসেছে কেজিতে ২১ টাকায়। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমে যাওয়া এবং কৃষক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর কারণে টিএসপিতে ভর্তুকির পরিমাণ ৫০ থেকে কমে ২৩ টাকা, এমওপি ৪১ টাকা থেকে কমে ৪০ টাকা এবং ডিএপিতে ৭৯ টাকা থেকে কমে ৪৯ টাকায় নেমেছে।
সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, 'সারের দাম বাড়ানোর কারণে কৃষকের উপর চাপ পড়বে, তবে উৎপাদন কমবে না। কৃষি মন্ত্রণালয় বীজ বা অন্যভাবে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করবে।'
তিনি বলেন, 'আমি চাই নি কোনোভাবেই সারের দাম বাড়ুক। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে ছিল, দাম বাড়াতেই হবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন সারের দাম না বাড়াতে, কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাড়াতেই হলো।'
কৃষিমন্ত্রী দাবি করেন, 'দাম যা বেড়েছে এটাও বৈশ্বিক সারের দাম যেভাবে বেড়েছে সে তুলনায় বাড়েনি। এখনও সরকারকে সারে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে। তবে বৈশ্বিক দাম কমে আসলে সারের দাম সমন্বয় করা হবে।'
কৃষিমন্ত্রী বিশ্ববাজারে সারের দাম কমলে দেশেও তা সমন্বয়ের কথা বললেও এমন সময়ে সারের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওযা হলো যখন কিনা বিশ্ববাজারে সারের দাম ধারাবাহিকভাবেই কমছে এবং সরকারের খরচও কমতে শুরু করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় ৩-৪ গুণ বেড়েছে। যে কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে ভর্তুকির খরচ ৭ হাজার ৪২০ কোটি থেকে বেড়ে ২০২১-২২ এ ২৮ হাজার কোটি টাকায় উঠেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকিতে ৪৬ হাজার কোটি টাকার দরকার পড়বে বলে জানায় মন্ত্রণালয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১ ধরনের ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টন সারের চাহিদার মধ্যে ২৭ লাখ টন ইউরিয়া, ডিএপি ১৬ লাখ টন, টিএসপি সাড়ে ৭ লাখ টন ও এমওপি ৯ লাখ টন নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
দেশে যত সার আমদানি হয় তার বড় অংশ করে কৃষি মন্ত্রণালয়। আর বাকিটা করে শিল্প মন্ত্রণালয়। কৃষি মন্ত্রণালয় বা এর অধীনস্থ সংস্থার সার আমদানিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সোনালী ব্যাংককে ১৬ হাজার কোটি টাকার এবং জনতা ব্যাংককে ৮ হাজার কোটি টাকার ক্রেডিট গ্যারান্টি দিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ কৃষি মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের অর্থ না দিয়েও এই দুই ব্যাংকের মাধ্যমে ২৪ হাজার কোটি টাকার সার আমদানি করতে পারবে। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বাড়লে এই গ্যারান্টির দ্বিগুণের বেশি অর্থের সার আমদানি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ব্যাংকগুলো কৃষি মন্ত্রণালয়কে এলসি খুলে দিলেও নিজেদের ব্যবস্থায় মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার নিয়ে সারের মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সুত্র জানিয়েছে, মূলত ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির চাপ এড়ানো ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভর্তুকি কমানোর শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সারের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কমে এলেও দেশে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে সার আমদানিতে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। কারণ এক বছরে ব্যবধানে ডলারের দর বেড়েছে ২৫ শতাংশ। সরকার বিনিময় হারের এই বাড়তি ব্যয়ের একটি অংশ কৃষকদের থেকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া আইএমএফের ভর্তুকি কমানোর চাপ রয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকি বাবদ অর্থ মন্ত্রণালয় ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে কৃষকরা তুলনামুলক বেশি সার ব্যবহার করে, যাকে 'অপচয়'ও বলা যেতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রতি হেক্টরে ৩২০ কেজি করে সার ব্যবহার হয়। যেখানে হেক্টরপ্রতি বৈশ্বিক গড় ১৮১ কেজি।