তৈরি পোশাক খাতের একাংশের জন্য আসছে কঠোর মূল্য সংযোজন বিধি
গার্মেন্টস খাতে বিদেশি ক্রেতাদের সরবরাহকৃত উপকরণের ওপর নির্ভরশীল রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তার পাওয়ার শর্তে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এ রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তার প্রাপ্তির যোগ্যতার বিষয়ে কঠোর প্রবিধান বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে সরকার, জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এছাড়া, বিলাসবহুল হোটেলের জন্য সামগ্রী আমদানিতে শুল্ক ছাড় আগামী বাজেটে প্রত্যাহার করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
কাটিং, মেকিং অ্যান্ড ট্রিমিং বা সিএমটি-তে বিদেশি ক্রেতা পোশাক তৈরির কাপড়সহ সকল উপকরণ বিনামূল্যে বাংলাদেশের রপ্তানিকারক বা উৎপাদককে দিয়ে থাকে। রপ্তানিকারক ওই কাপড় কেটে, সেলাই করে পোশাক তৈরির পর বিদেশের ক্রেতাকে পাঠান।
সিএমটি ভিত্তিতে রপ্তানি পণ্যে নগদ সহায়তার জন্য বর্তমানে কমপক্ষে ২০% মূল্য সংযোজন করার শর্ত রয়েছে।
বিদেশি ক্রেতা কত মূল্যের কাপড় ও অন্যান্য উপকরণ বিনামূল্যে দিলো এবং তা দিয়ে উৎপাদিত পণ্যের এফওবি মূল্যের পার্থক্যের ভিত্তিতে এই মূল্য সংযোজনের হিসাব করা হতো। এর থেকে জাহাজ ভাড়া বাদ দেওয়া হতো।
কিন্তু প্রস্তাবিত নতুন নিয়মে স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য এবং সিএমটি উপকরণের মূল্যের ভিত্তিতে এই মূল্য সংযোজন হার গণনা করা হবে।
এই পোশাক তৈরি ও ক্রেতাদেরকে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা স্থানীয় বাজার থেকে কার্টন, পলি, প্রিন্টিং, লেবেল ইত্যাদি কিনে থাকেন। এসব কেনাকাটা, শ্রমিক মজুরি ও মুনাফা যোগ করে ২০% শতাংশ মূল্য সংযোজন হলেই রপ্তানিকারক নগদ সহায়তা পান।
রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, তৈরি পোশাক খাতের মোট রপ্তানির ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সিএমটি ভিত্তিতে হয়ে থাকে।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪২.৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল) ৩৮.৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর প্রথম সহ সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, সিএমটি ভিত্তিতে রপ্তানি হওয়া পণ্যে কতটা মূল্য সংযোজন হচ্ছে তা সব সময়ই ষ্পষ্ট। কারণ বিদেশি ক্রেতারা কাপড়সহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিনামূল্যে সরবরাহ করেন।
তিনি বলেন, "যেভাবেই হিসাব করা হোক সেটা সহজ হতে হবে। যাতে রপ্তানিকারক সহজে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হিসাবগুলো দিতে পারেন। এমন কোনো পদ্ধতি চালু করা ঠিক হবে না যাতে কার্যক্রম জটিল হয়ে পড়ে।"
নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম বলেন, "হিসাব পদ্ধতি আধুনিক, উন্নত ও সহজ হলে সেটা অবশ্যই ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো হবে। কিন্তু এমন কোনো পদ্ধতিতে যাওয়া ঠিক হবে না যেখানে জটিলতা সৃষ্টি হয়।"
বিলাসবহুল হোটেলের রেয়াতি শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে
দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে হোটেল নির্মাণে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানিতে বড় ধরনের শুল্ক ছাড় দিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এই সুবিধা তুলে নিচ্ছে তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ এর পরামর্শে সরকার বিভিন্ন খাতের ভর্ভুকি ও রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করছে। তার ধারাবাহিতকায় এবার প্রত্যাহার করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত বিলাসবহুল ও তারকা মানের আবাসিক হোটেল নির্মাণে রেয়াতি সুবিধায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির সুযোগ।
তবে এতে পর্যটন খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এনবিআরের জারিকৃত এসআরও-র মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত বিলাসবহুল ও মানসম্পন্ন আবাসিক হোটেল নির্মাণের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রায় দশ বছর তারা এই সুবিধা পেয়েছে।
বর্তমানে বিভিন্ন এইচএস কোডের অধীনে বিভিন্ন আমদানি উপকরণের উপর আগের মতো ১১০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে।
হোটেলের ভেতরে সাজসজ্জা বা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, লাইটিং, ইলেকট্রনিক্সসহ অন্তত ৪০টি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, পর্যটন খাতের বিকাশের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন হোটেল নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ আমদানিতে ছাড় ছিল। তবে বর্তমানে সরকার মনে করে এ খাত যথেষ্ট বিকশিত হয়েছে। সরকারি নীতি সহায়তা ছাড়াই তারা এগিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেছে।
দীর্ঘমেয়াদে কোনো খাতে ছাড় অব্যাহত রাখলে তারা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়। তখন তারা প্রতিনিয়ত আরও সুবিধা পেতে চায়। অন্যদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। এতে এখাতে কোন প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি মো. সামির সাত্তার বলেন, সরকার রাজস্ব আদায়ে বদ্ধপরিকর; কিন্তু তা এ খাতের ভোক্তাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রেয়াতি শুল্ক সুবিধার কারণে থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও হোটেল সেক্টর ইতিমধ্যেই বেশ উন্নত।
"এ খাতের উদ্যোক্তারাও ভালো করছে। এখন বিরতি নেওয়ার সময়। প্রয়োজনে সরকার এ নিয়ে ভবিষ্যতে বিবেচনা করতে পারে," যোগ করেন তিনি।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ আরও পরামর্শ দেন, সরকার বিভিন্ন খাবারের আমদানিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দিতে পারে, যা দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের বাংলাদেশে আকৃষ্ট করতে সহায়তা করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নির্মাণ সামগ্রীর দাম আগের চেয়ে অনেক বেশি, ডলারের দামও ঊর্ধ্বমুখী। সেক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে এ খাত বিকশিত হতে বাধাগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশে ২০১৭ সালে বিদেশি নাগরিক আগমন করেছেন ৫ লাখের বেশি। এছাড়া ২০১৮ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন।