স্বাস্থ্য ও হাইজিন খাত বাজেটে সহায়তা পাবে...
আসন্ন বাজেটে আরো ওষুধ ও মেডিকেল সরঞ্জাম উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত দিতে পারে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপ স্থানীয় শিল্পকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতও তার সুফল পাবে।
একইসঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী হিসেবে স্যানিটারি ন্যাপকিন, ডায়াপার ও টয়লেট্রিজের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদও এক বছর বাড়তে পারে। এসব কিছুই জনস্বাস্থ্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য অপরিহার্য।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, চিকিৎসাকে আরও সাশ্রয়ী করতে সরকার বিদ্যমান শুল্ক মওকুফের তালিকায় অ্যান্টি-ক্যান্সার এবং অ্যান্টি-ডায়াবেটিস ওষুধের আরও কাঁচামাল অন্তর্ভুক্ত করতে চলেছে।
ইন্ট্রাভেনাস ক্যানুলা তৈরির জন্য সিলিকন টিউব আমদানিতেও শুল্ক রেয়াত দেওয়া হতে পারে।
আগামী বাজেটে তরল নিকোটিন এবং ট্রান্সডার্মাল নিকোটিন প্যাচের উপর ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। পাশাপাশি ই-সিগারেট, ভেপ এবং এ জাতীয় ডিভাইসগুলির ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে ২১২.২০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হতে পারে।
বাজেটের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সংশ্লিষ্ট শিল্পের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং স্বাস্থ্য- অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে জনস্বাস্থ্য খাতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদের মতে, অ্যান্টি-ক্যান্সার এবং অ্যান্টি-ডায়াবেটিস ওষুধের কাঁচামাল আমদানিকে শুল্ক মওকুফের আওতায় আনা হবে খুবই ভালো একটি পদক্ষেপ।
সব ধরনের মেডিকেল কাঁচামাল শুল্কমুক্ত হওয়া উচিত, একইসঙ্গে তাদের মূল্য নির্ধারণে কড়া নজরদারিও থাকা দরকার– দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
ব্যয়বহুল ওষুধের কারণে ক্যান্সারের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোগীর সামর্থ্য অনুযায়ী, বছরে ৩ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত মূল চিকিৎসা ব্যয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্যমতে, দেশে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে।
গ্লোবোকান ২০২০-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১.৫৬ লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয় এবং ক্যান্সারে মৃত্যু হয় ১.০৮ লাখ জনের।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সোসাইটির তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩.১ মিলিয়ন।
২০১৯ সালে বিএমসি হেলথ সার্ভিসেস রিসার্চের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিজন টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর গড় বার্ষিক চিকিৎসা খরচ ছিল ৯৩,৮১৯.৯৫ টাকা। এরমধ্যে ওষুধের খরচ প্রত্যক্ষ খরচের ৬০.৭ শতাংশ এবং হাসপাতালে ভর্তির খরচ ২৭.৭ শতাংশ।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের প্রধান প্রধান ওষুধের কাঁচামাল যদি শূন্য শুল্ক দিয়ে আমদানি করা যায়, তাহলে এসব ওষুধের দাম অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে।
ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের ওষুধের জন্য ১০০-রও বেশি ধরনের কাঁচামাল আমদানি করে বাংলাদেশ এবং এরমধ্যে প্রায় ৭৬ কাঁচামাল ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
তারা জানান, বর্তমানে ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদনের মাত্র ৩০ শতাংশ কাঁচামালে আমদানি শুল্ক অব্যাহতি দেয় সরকার।
বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস-এর গ্লোবাল বিজনেস ডেভেলপমেন্টের পরিচালক মঞ্জুরুল আলম বলেন, "আমরা ১০০ ধরনের ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি করছি।"
সরকার যদি সমস্ত কাঁচামালের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করে, তাহলে স্থানীয় শিল্প আরও সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতে সহায়তা পাবে। বর্তমানে স্থানীয় প্রস্তুতকারকরা আমদানিকৃত ওষুধের তুলনায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কম দামে ক্যান্সারের ওষুধ বিক্রি করে বলে জানান তিনি।
মঞ্জুরুল আলম কিডনি ও কার্ডিয়াক ওষুধের কাঁচামাল শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দিতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তার মন্তব্যকে সমর্থন করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই)-র মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, বেশ কিছু কোম্পানি দেশে অনকোলজিক্যাল ড্রাগ উৎপাদন করছে, ফলে এসব ওষুধ কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে।
ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আগে এ ধরনের ওষুধ প্রায় ১,০০০ ডলারে আমদানি করতে হতো, কিন্তু স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো তা ৫০০ টাকায় বিক্রি করছে। এই প্রেক্ষাপটে, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের ওষুধ উৎপাদনে ভ্যাট-ট্যাক্স অব্যাহতির দাবি জানান তিনি।
বিগত ১২ বছরে বিকন, এসকেএফ, রেনাটা, ইনসেপ্টা, হেলথকেয়ার এবং টেকনো ফার্মার মতো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি ১০০টিরও বেশি ধরনের অনকোলজিকাল ওষুধ উৎপাদন করছে।
স্যানিটারি প্যাড ও ডায়াপারের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি বজায় থাকতে পারে
স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পের আরও বিকাশে সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে সরকার ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত স্যানিটারি প্যাড এবং ডায়াপারের কাঁচামালের ক্ষেত্রে ভ্যাট ছাড় অব্যাহত রাখতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও ওয়াটারএইডের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত 'ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮' অনুসারে, দেশে মাসিকের সময় ২৯ শতাংশ নারী ডিসপোজিবল প্যাড ব্যবহার ব্যবহার করে, ২০১৪ সালের জরিপকালে যা ছিল ১৪ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে স্যানিটারি বাজার প্রায় ৭০০ কোটি টাকার এবং বার্ষিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারে তা আরো বড় হচ্ছে।
এই চাহিদার বেশিরভাগই পূরণ করছে স্থানীয় কোম্পানিগুলো।
এছাড়া, ডায়াপারের বাজার প্রায় ৮০০ কোটি টাকার, এর প্রায় ৯০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে স্থানীয় উৎপাদকরা।
এসিআই লিমিটেডের বিজনেস ডিরেক্টর কামরুল হাসান টিবিএস'কে বলেন, "স্যানিটারি নাপকিনের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে। এ সুবিধা অব্যাহত না রাখাই হবে যৌক্তিক, তাতে স্থানীয় শিল্পও সুরক্ষা পাবে।"
এবিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "চাইলেই কিছু সুবিধা রাতারাতি বাতিল করা যায় না। কেননা সুবিধা দেওয়ার কারণে এসব খাতে বিনিয়োগ এসেছে।"
এছাড়া, সাবান ও শ্যাম্পুর কাঁচামাল লাবসা ও এসএলইস- এর উৎপাদন পর্যায়ে বর্তমানের হ্রাসকৃত ৫ শতাংশ ভ্যাট সুবিধা আরো এক বছর বাড়ানো হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে টয়লেট্রিজ ও স্কিনকেয়ার পণ্যের বাজার প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের এবং বার্ষিক ১২.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারে যা আরো বড় হচ্ছে।
বাংলাদেশে ২০১১ সালের দিকে সাবান ও শ্যাম্পুর কাঁচামাল তৈরি শুরু হয় রিমার্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। তবে এই কাঁচামাল দেশে সবচেয়ে বেশি বিপণন করছে এককভাবে ইউনাইটেড সালফো- কেমিক্যালস লিমিটেড (ইউএসসিএল)।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন টিবিএস'কে বলেন, "আমাদেরকে এ সুবিধা (ভ্যাট হার কমানো) দেওয়া হয়েছে এক বছর আগে। এই সুবিধা অব্যাহত রাখলে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা এবং প্রতিযোগিতামূলক দামে এই কাঁচামাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।"
ইউনিলিভার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জাভেদ আখতার টিবিএসকে বলেন, "এ সুবিধা বাতিল হলে হয়তো এসব এসব পণ্যের দাম বেড়ে যেত। অব্যাহত রাখার ফলে বাজারে প্রভাব পড়বে না।"