৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা: শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কম, পরিবহন খাতে কেন বরাদ্দ বেশি?
বিগত কয়েক অর্থবছরের মতো আগামী বাজেটেও সরকার স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে কম এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে বেশি বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে কম বরাদ্দের এই সিদ্ধান্ত সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকম্পনার সময়সীমা ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত; এই সময়ের মধ্যে বেশকিছু উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অর্জনে সহায়তা করবে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি)।
কিন্তু ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রতি অর্থবছরের এডিপিতে যে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, বাস্তবে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে প্রতি অর্থবছরেই তারচেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি হারে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আবার এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্যখাতে। এই খাতে ৫ শতাংশ কম হারে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
একই চিত্র দেখা গেছে শিক্ষা খাতেও; এতে প্রশ্ন উঠেছে- কেন দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা হলেও তা অনুসরণ করা হয় না?
আগামী অর্থবছরে মোট এডিপি বরাদ্দের ২৮.৮৮ শতাংশ দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ খাতে ১৭.৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তুলনায় এ খাতে আগামী অর্থবছরে প্রায় ১১.৪৮ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, আগামী অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দে ৫.৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে। যদিও এ খাতে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আগামী অর্থবছরে ১১.১ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল। ফলে বরাদ্দ ৫.৫ শতাংশ কম এসেছে।
এছাড়া, গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলী খাতে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তুলনায় এডিপিতে সাড়ে তিনশুণ বরাদ্দ বড়ানো হলেও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বারাদ্দ প্রায় অর্ধেক কমানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)- এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি টিবিএসকে বলেন, "সরকার উন্নয়নের একটি লক্ষ্য নিয়ে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। যে লক্ষ্য অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব দেওয়া হয়। কোনো খাতে বরাদ্দ কমানো বা বাড়ানো হলে তার ব্যাখ্যা থাকা দরকার।"
"সরকার সমন্বিত উন্নয়ন বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করে। উন্নয়ন কখনও কখনও অবকাঠামো কেন্দ্রীক হতে পারে। তবে এ কারণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে কখনো কাঙ্খিত, টেকসই উন্নয়ন অর্জন হতে পারে না। এই উন্নয়ন সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না।"
জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যখন প্রণয়ন করা হয়েছিল, তখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতিতে এখন পরিবর্তন এসেছে।
"পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির সময় আমরা জানতাম না এ ধরনের একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। আবার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। এখন তা বেড়ে ১০৮ টাকা হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বরাদ্দ পরিবর্তন করা হচ্ছে।"
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, প্রতি অর্থবছর যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, অনেক খাতই তা ব্যয় করতে পারে না। বিশেষ করে, সক্ষমতার অভাবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। বেশি বরাদ্দ দিয়ে লাভ নেই, যদি না সেটি ব্যবহার করা যায়। এ কারণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমছে।
পরিবহন অবকাঠামো কেন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে?
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সরকার গত এক দশক ধরে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এ কারণে এ খাতে মেগা প্রকল্পের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রকল্প সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বরাদ্দের চাহিদা বাড়ছে।
এছাড়া, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনেকগুলো আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরির সময় এসব প্রকল্পের ধারণা ছিল না। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনগুলোর আবাসন সংক্রান্ত প্রকল্পও বেড়েছে। এ কারণে গৃহায়ণ ও কমিউনিটিস সুবিধাবলী খাতে বরাদ্দ ব্যাপকভাবে বেড়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন।
অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা কারণেও পরিবহন ও যোগযোগ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে বলে মনে করেন পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মোঃ মামুন-আল-রশিদ। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন, রেলসহ যোগাযোগ খাতের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা বেড়েছে। আবার এডিপিতে স্বাস্থ্য বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তারা সেটি ব্যয় করতে পারে না। এ কারণে যেসব খাতে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না, সেখান থেকে বরাদ্দ কমানো হয়। এই বরাদ্দ চলে যাচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে।
ড. মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, সরকার উন্নয়নকে দৃষ্টমান করে অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতের প্রকল্পে উন্নয়ন পরিলক্ষিত হতে সময় লাগে। এ কারণে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে।
আবার রাজনৈতিক কারণেও কোনো কোনো খাতে বরাদ্দ বাড়ে। কোনো মন্ত্রণালয়ে কর্তাব্যক্তিরা তাদের ক্ষমতাবলে অনেক বেশি বরাদ্দ নিয়ে যান, যা পরিবহন অবকাঠামো সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়গুলোতে দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বরাদ্দ ছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না স্বাস্থ্যখাতে
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের স্বাস্থ্যখাতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার রয়েছে। কিন্ত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় না হওয়ায় এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাই হবে এই পরিকল্পনা মেয়াদে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন।
এছাড়া, অসংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যুহার মোকাবেলা করার ক্ষেত্রেও রয়েছে চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসা সেবা গ্রহণকারীর ব্যয় সাধ্যের মধ্যে রাখা, প্রয়োজনী পুষ্টি সেবার পরিধি ও গুণগত মান বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিতকরণ স্বাস্থ্যখাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জিডিপি অনুপাতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয় অষ্টম বার্ষিক পরিকল্পনায়।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, কোভিডের সময়ে প্রণয়ন করা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য খাতকে সরকার অগ্রাধিকার দেয়। কিন্ত এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে স্বাস্থ্যখাতে ১৯,২৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু পরে ব্যয় করা সম্ভব হবে না বিবেচনায় সংশোধিত এডিপিতে তা কমিয়ে ১২,৭৪৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত সংশোধিত এডিপি বরাদ্দেরও শতাভাগ ব্যয় না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) স্বাস্থ্য বিভাগ বরাদ্দের মাত্র ৩৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে।
এর আগে ২০২১-২২, ২০২০-২১ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সংশোধিত এডিপি বরাদ্দের যাথাক্রমে ২১ শতাংশ, ৪২.১২ শতাংশ, এবং ২৬ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি।
যদিও আগামী বছরের চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় নতুন এডিপিতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বেড়ছে প্রায় ২৭ শতাংশ। কিন্ত এই অর্থ ব্যয় হবে কি না, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকনোমিকসের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ টিবিএসকে বলেন, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যখাতকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, এডিপির বরাদ্দে সে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সে কারণে পরিকল্পনার তুলনায় স্বাস্থ্যখাতে প্রায় ৪০ শতাংশ বরাদ্দ কমেছে। সরকার হয়তো এখন স্বাস্থ্যখাতের তুলনায় বিদ্যুৎ বা গৃহায়ণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে; তাই এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ছে।
এডিবির বরাদ্দ কমে গেলে স্বাস্থ্যখোতের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে এর প্রভাব ভোগ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন এই অধ্যাপক।
উপেক্ষিত হচ্ছে শিক্ষাখাতও
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের এডিপিতে শিক্ষাখাতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১১.৩৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যদিও সংশোধিত এডিপিতে এই বরাদ্দ আরও কমতে পারে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতকে একসঙ্গে দেখানো হয়েছে। এই দুই খাতে ২০২৪ অর্থবছরে ১৬.৫ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল। কিন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৩.৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এডিবিতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিক্ষার ওপর। প্রথমত, আমাদের দেশে শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটেছে; আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, স্কুলে যাওয়ার মত বাচ্চার সংখ্যাও বাড়ছে। পাশাপাশি প্রতিটি পরিবার এখন বাচ্চাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছে। এসব শিশুদের সঠিকভাবে পড়াশুনা করানোর জন্য অর্থ প্রয়োজন।"
"দ্বিতীয়ত, আমরা শিক্ষায় ডিজিটালাইশেন করছি, এটি কিন্তু ব্যয় সাপেক্ষ। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে চাই তাহলে আমাদের প্রযুক্তিগত শিক্ষাটাকে অনেক বেশি সম্প্রসারণ করতে হবে।"
"তৃতীয়ত, শিক্ষকদের দুর্বলতার কথা আমরা বলি। শিক্ষকদের বেতন না বাড়লে এ পেশায় তো মেধাবীরা আসবে না। শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। এজন্য বরাদ্দও বাড়াতে হবে।"
"শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে দেখছি এডিবির বরাদ্দ কমেছে। যদি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমে, তাহলে জাতি অনুন্নত থেকে যাবে। ২০৪১ সালের মধ্যে সরকারের যে ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশন আছে, সেটিও বাধাগ্রস্ত হবে," যোগ করেন এই শিক্ষাবিদ।