২০২২-২৩ অর্থবছরে ট্রেজারি বিল থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে ৬৫,০০০ কোটি টাকা
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সরকারের অভ্যন্তরীণ দেনার পরিমাণ বাড়ছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
এবারের মূল বাজেটে অভ্যন্তরীণ দেনার পরিমাণ ১.৬৬ লাখ কোটি টাকায় আটকে রাখতে চেয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ২.৩৯ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর কারণ প্রধানত রাজস্ব আয় কমে যাওয়া, টাকার অবমূল্যায়ন এবং সুদব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাওয়া।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ট্রেজারি বিলে সরকারের যে পরিমাণ দেনা প্রাক্কলন করা হয়েছিল, অর্থবছর শেষে তা ৪৯ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে সংশোধিত বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ট্রেজারি বিলে সরকারের দায় ১.৩১ লাখ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১.৯৫ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১.০৬ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১.১১ লাখ কোটি টাকা করা হচ্ছে।
সরকারের অভ্যন্তরীণ দেনা বাড়ার কারণে সংশোধিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদব্যয়ও মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে।
ট্রেজারি বিল ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের দেনার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, এই ঋণ সরকারের দেনার বোঝা বাড়াবে, ব্যাংকি ব্যবস্থায় তারল্য সরবরাহ কমবে, এবং খুব সম্ভব সুদহার বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকার ঋণ নেওয়া বাড়ালে চূড়ান্তভাবে তার প্রভাব বেসরকারি খাতে, বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাতে পড়বে।
মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি হবে। আবার তারল্য সংকট দেখা দেবে। যাকে বলা হয় "ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট"। এর অর্থ হচ্ছে বাজার থেকে অন্যদের ঠেলে বের করে দেওয়া।'
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের কৃচ্ছ্রতাসাধন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ডলার সংকটের কারণে আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমায় রাজস্ব আদায়ে বড় আকারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে জানান তারা।
এর ফলে ব্যয় কমলেও বাজেট ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে, যা মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া বাড়াতে হচ্ছে।
এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ২৯ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত এক মাসে সর্বোচ্চ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৩-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মোট ঋণ নিয়েছে ৮২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। এই ঋণের ৮০ শতাংশই জোগান দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেনা বাড়ার ঝুঁকি
বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার সময় বাজেটে মধ্যমেয়াদি 'ফিসক্যাল রিস্ক' নির্ধারণ এবং তা মোকাবেলার উপায় সম্পর্কে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোতে একটি বিস্তারিত অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে আইএমএফ।
এর অংশ হিসেবে আগামী বাজেটে এ বিষয়ে সরকারের নীতি-বিবৃতি ঘোষণা করা হবে।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, কোনো কারণে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আয় অনেক কমে গেলে, ভর্তুকির চাহিদা অনেক বেড়ে গেলে কিংবা আন্তর্জাতিক সংকটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়লে বা কোভিডের মতো কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যায় মারাত্মক শস্যহানি হওয়ার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কোন ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হবে, এবং তা মোকাবেলার জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে—সে বিষয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটের মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোতে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, চলতি অর্থবছরসহ গত কয়েক অর্থবছরের বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে সেখানে দেখানো হয়েছে যে মধ্যমেয়াদে বা আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আশঙ্কা করার মতো কোনো ঝুঁকি নেই।
এমনকি চলতি অর্থবছরের বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি বকেয়া রাখা, ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বাড়ানো, সরকারের অভ্যন্তরীণ দায় বেড়ে যাওয়া এবং সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়াও মধ্যমেয়াদে কোনো ফিসক্যাল ঝুঁকি সৃষ্টি করবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ট্রেজারি বিল
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মে মাসে ট্রেজারি বিল থেকে সরকার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগামী জুনে আরও ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
গত ২২ মে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের নিলামে ব্যাংকগুলো ৩ হাজার ৩৫ কোটি টাকা নিয়েছে। ওই দিনের নিলামে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে সুদহার ছিল ৬.৭০ শতাংশ। আর ১৮২ দিন মেয়াদি বিলের সুদহার ছিল ৭.০২ শতাংশ। আর ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলে সুদহার ছিল ৭.৭০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি ট্রেজারি বিলের নিলামে ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তিন মাস আগে ট্রেজারি বিলে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ করত, সম্প্রতি তার ১০ গুণ বেশি বিনিয়োগ আসছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পায় না, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে।
এর ফলে আগামী বাজেটে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩৩.৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
আর কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ না হলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'ব্যাংক থেকে সরকারের অধিক ঋণ নেওয়া সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো না। সরকার বেশি সুদে ঋণ নিচ্ছে। ট্রেজারি বিলে ব্যাংক ৬ বা ৭ শতাংশ কিংবা আরও বেশি সুদ পাচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।'
তবে ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট পরিস্থিতি কাটতে শুরু করেছে এবং বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে।
তাই সরকার স্বল্প মেয়াদে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বাড়ালে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেন তারা।
ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, 'সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিতে থাকলে বেসরকারি খাতে তারল্য সরবরাহ কমতে থাকে। এতে বেসরকারি খাতের চাহিদা পূরণ অনেকসময় কঠিন হয়। তবে সম্প্রতি বেসরকারি খাতের ঋণ চাহিদা তেমন নেই। নতুন প্রকল্প বা চলমান কার্যক্রমের সম্প্রসারণের জন্য তেমন ঋণ চাহিদা দেখা যাচ্ছে না। ফলে সরকারের বাড়তি ঋণ বিশেষ কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবীবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, সংশোধিত বাজেটে সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
'তাই সরকার বেশি ঋণ নিলে বা দেনা বেড়ে গেলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। এছাড়া বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য পরিস্থিতি ভালো,' বলেন তিনি।
হাবীবুর রহমান আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সরকারও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ বাড়িয়েছে। অর্থবছরের শেষের দিকে বেশি ঋণ নেওয়া স্বাভাবিক।'