ব্যাংক খাতে এপ্রিলে আমানত বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা
গত কয়েক মাস ধরেই ৯% এর বেশি হারে মূল্যস্ফীতি হলেও ব্যাংকখাতের উপর গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসায় এপ্রিলে আমানত বেড়েছে প্রায় ২৫০০০ কোটি টাকা।
তবে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে আমানত সেভাবে বাড়ছে না, উল্টো এই ধারার বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এক্সেস লিকুইডিটি নেগেটিভে চলে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এপ্রিল মাস শেষে ব্যাংক খাতের আমানত দাঁড়িয়েছে ১৫.৪৮ লাখ কোটি টাকা। মার্চ মাসে এটি ছিল ১৫.২৩ লাখ কোটি টাকা।
গত এক মাসে যে পরিমাণ আমানত বেড়েছে এর সিংহভাগ (প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা) বিভিন্ন মেয়াদের টাইম ডিপোজিট, বাকিটা ডিমান্ড ডিপোজিট।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, ব্যাংক খাতে গ্রাহকদের আস্থা ফিরছে, এটা সত্য। তবে এটি সব ব্যাংকে সমানভাবে বাড়ছে না। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিট করার ক্ষেত্রে এখনো গ্রাহকেরা ভরসা করতে পারছেন না। এসব কারণে গ্রাহকেরা কনভেনশন ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা করছে। কারণ, কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোতে এখনো বড় ধরনের স্ক্যামের ঘটনা ঘটেনি।
এছাড়া কনভেনশনাল কিছু ব্যাংকে গুড গভর্নেন্স আছে, সেইসঙ্গে তাদের পারর্ফমেন্সও ভালো, তাই এই ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিট বেশি যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এপ্রিলে ডিপোজিটের গ্রোথ গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮.৫৪% হয়েছে। এর আগে ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংক থেকে অনিয়ম করে ঋণ বিতরণের কারণে গতবছরের ডিসেম্বরে ডিপোজিটের গ্রোথ ৬% এর নিচে নেমে গিয়েছিল। অবশ্য এর পর থেকে গ্রোথ রেট বৃদ্ধির দিকে রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিটের পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়ছে উল্লেখ করে সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম টিবিএসকে বলেন, "গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে গুজবের কারণে ব্যাংকখাতে কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছিল। তবে সেটি এখন কাটতে শুরু করেছে। গ্রাহকদের ব্যাংক খাতের উপর আস্থা ফিরে আসছে, যার রেজাল্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ডিপোজিটের গ্রোথে। এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য অবশ্যই একটা ভালো মেসেজ।"
তবে, ব্যাংক খাতে ডিপোজিটের গ্রোথ ভালো হলেও লোনে খুব বেশি গ্রোথ দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এপ্রিলের আগের মাসের তুলনায় লোন মাত্র ৬,৫৭৬ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪.৩৫ লাখ কোটি টাকা।
আমদানি এলসি কমে যাওয়াই লোন গ্রোথ কম হওয়ার অন্যতম কারণ উল্লেখ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বলেন, ইমপোর্ট এলসি খোলা বাড়লে প্রাইভেট সেক্টরে লোনের ডিমান্ড তৈরি হয়। এখন এলসি খোলা অনেক কমে গেছে।
তিনি আরো জানান, আগে যেখানে প্রতি মাসে গড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো এলসি খোলা হতো, এখন সেটি ৪-৫ বিলিয়নে নেমে এসেছে। এছাড়া জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইনভেস্টমেন্টও কম হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এপ্রিলে কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক বা মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ মার্চের তুলনায় ৮৭০৫ কোটি টাকা বাড়লেও এ মাসের প্রান্তিক প্রবৃদ্ধি আগের ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন (১১.২৩%) অবস্থানে আছে।
গতবছরের ডিসেম্বরে এই গ্রোথ ২৭% পার করে। অর্থাৎ, মানুষ হাতে টাকা রাখার বদলে ব্যাংকে টাকা জমা রাখাতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এটিও ব্যাংক খাতে ডিপোজিট বাড়ার একটি কারণ, বলছেন ব্যাংকাররা।
ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি ব্যাপক কমেছে
দেশের ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের আমানতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবাহ ও এক্সেস তারল্য ব্যাপক হারে কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেভেলপমেন্টস অব ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ (জানুয়ারি- মার্চ ২০২৩) রিপোর্ট থেকে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে চলতি ২০২৩ এর মার্চ প্রান্তিকে আগের বছরের তুলনায় গ্রাহকের আমানত বেড়েছে ৫১৭০ কোটি টাকা বা ১.৩৮%।
যদিও ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত আমানতের প্রবৃদ্ধি হার ছিল ১৫% এর বেশি।
একইসঙ্গে চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে আগের বছরের তুলনায় ঋণ বেড়েছে ১৩.৪৫% বা ৪৬,০১১ কোটি টাকা। এই ঋণের প্রবৃদ্ধি গত চার বছরের একই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।
শরিয়াভিত্তিক একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করা শর্তে টিবিএসকে বলেন, শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের সকল আর্থিক সূচক অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় ভালো ছিল। যদিও গ্লোবাল ক্রাইসিসের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছরে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি কমার কিছুটা কারণ রয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে একাধিক শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের তথ্য প্রকাশিত হওয়ায় অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকগুলোতেও প্রভাব পড়েছে। গ্রাহক নতুন করে আমানত না রেখে টাকা তুলে নিয়েছে, এর ফলে আমানতের প্রবৃদ্ধি অনেকটা কমেছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ইসলামিক ব্যাংকগুলোর এক্সেস লিকুইডিটি চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণে কমেছে।
২০২২ এর মার্চ শেষে এক্সেস লিকুইডিটির পরিমাণ ছিল ২৫,১৩৭ কোটি টাকা। যা চলতি বছরের মার্চে এসে কমে দাঁড়িয়েছে ১৯৯০ কোটি টাকা। সে হিসেবে আগের বছরের তুলনায় এটি কমেছে ৯২%।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের যে পরিমাণে আমানতে বেড়েছে তার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ঋণ বাড়ার কারণে এক্সেস লিকুইডিটি কমে এসেছে।
সাধারণত ইসলামী ব্যাংকগুলোর লোন বেড়ে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে, কিন্তু লিকুইড অ্যাসেট কমেছে। যার কারণে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর তারল্যের সংকট কমাতে গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।