জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা, মাসে দিতে হবে ৫০০-৫,০০০ টাকা
আগামী জুলাই থেকে দেশব্যাপী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা শুরু করতে চলেছে সরকার। এতে ব্যক্তিপ্রতি চাঁদার অঙ্ক সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, ৫০ বছরের অধিক বয়সীরাও সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর তারা আজীবন পেনশন পাওয়া শুরু করবেন।
প্রাথমিকভাবে এই স্কিমের আওতায় চারটি শ্রেণিকে টার্গেট করা হচ্ছে: বেসরকারিখাতের চাকরিজীবী, প্রবাসী বাংলাদেশি, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী এবং অস্বচ্ছল ব্যক্তিসমূহ।
কর্মকর্তারা বলেছেন, অস্বচ্ছল ক্যাটাগরিতে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরতদের রাখা হবে। তবে তাদের কিভাবে চিহ্নিত করা হবে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অতি-দরিদ্র হিসেবে সরকারি সুবিধাভুক্তদের এ ক্যাটাগরিতে রাখা হতে পারে। তাদের মাসিক চাঁদার হার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে রিকশাওয়ালা, হকার, গৃহকর্মী, পথে পণ্যসামগ্রী বিক্রেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন অন্তর্ভুক্ত হবেন।
প্রবাসী বাংলাদেশী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ব্যক্তিদের মাসিক চাঁদার হার সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫,০০০ টাকা হতে পারে।
অন্যদিকে, বেসরকারিখাতের চাকরিজীবীদের চাঁদার হার সর্বনিম্ন ১,০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫,০০০ টাকা নির্ধারণ হতে পারে।
এদের মধ্যে শুধু অস্বচ্ছলদের চাঁদায় ৫০ শতাংশ সহায়তা করবে সরকার। বাকিদের চাঁদায় সরকারের কোন অবদান থাকবে না।
পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্তরা তাদের চাঁদার বিপরীতে সরকার থেকে সুদ পাবেন। তবে এই সুদহার কতো হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে তা ব্যাংকের আমানতের সুদহারের চেয়ে বেশি, কিন্তু সঞ্চয়পত্রের বিদ্যমান সুদ হারের চেয়ে কিছুটা কম হতে পারে বলে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সুদহার নির্ধারণের হিসাব করছে মন্ত্রণালয়। আবার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম দিয়েও পৃথকভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই সুদহার চূড়ান্ত করা হবে বলে জানান তারা।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় আছে ১৮-৫০ বছর বয়সী নাগরিকরা। প্রাসঙ্গিক আইনে ৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের বাদ দেওয়া হলেও, পরে বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে তাদেরকে এর আওতায় আনা হয়।
বিধিমালা অনুসারে, ৫০ বছরের অধিক বয়সীরাও সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে অন্যদের মতো ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন না তারা। বরং, ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর তারা আজীবন পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। অর্থাৎ, কেউ ৬০ বছর বয়সে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হলে, তিনি ১০ বছর চাঁদা পরিশোধের পর ৭০ বছর বয়স থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন।
কর্মকর্তারা জানান, তারা নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তুতি সম্পন্ন করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর শিডিউল চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তিনি যেদিন সময় দিবেন, সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে দেশব্যাপী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার লক্ষ্য – বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়া, সামাজিক কল্যাণ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
'সর্বজনীন পেনশনের কোন পাইলটিং নয়; প্রধানমন্ত্রী যেদিন উদ্বোধন করবেন, সেদিন থেকেই পুরোদমে সারাদেশে এটা শুরু হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অস্বচ্ছল দু'-তিনজনসহ অন্যান্য প্রোডাক্টের কয়েকজনকে উপস্থিত রেখে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন ঘোষণা করবেন'- জানান সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
৫০ বছরের অধিক বয়সীদের পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'বিভিন্ন পর্যায় থেকে সিনিয়র নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ আসতে থাকে। তার পরিপ্রেক্ষিতে, সর্বজনীন পেনশন বিধিমালায় ৫০ বছরের অধিক বয়সীদেরও অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রাখা হচ্ছে। তবে অধিক বয়সীরা ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পর থেকে পেনশন সুবিধা পাবেন।'
সর্বজনীন পেনশনে যারা অন্তর্ভুক্ত হবেন, শুরুতে তারা শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে চাঁদার টাকা জমা দেবেন। এজন্য পেনশন কর্তৃপক্ষ – অর্থবিভাগ ও সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে চলতি মাসেই একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে। পরে অন্যান্য ব্যাংক এই ব্যবস্থায় যুক্ত হবে।
শুরুতে প্রবাসীদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে সরকার থেকে জোর প্রচেষ্টা নেওয়া হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় আশা করছে, প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিলে চলমান ডলার সংকট পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
অন্য তিনটি প্রোডাক্টে অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশি মুদ্রায় চাঁদা দেবে, যা সরকার লাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে। এতে আগামী বছরগুলোতে সরকারের ব্যাংকঋণ নির্ভরতা ব্যাপক মাত্রায় কমবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা।
কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলছেন, প্রথম ১০ বছর সার্বজনীন পেনশনের চাঁদা বাবদ সরকার শুধু টাকা গ্রহণ করবে। এই ১০ বছর সরকারকে কোন টাকা পরিশোধ করতে হবে না। ১০ বছর পর থেকে পেনশন বাবদ অর্থ ব্যয় হওয়া শুরু হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান – পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে সরকার অবশ্যই সহজে অর্থ নেওয়ার সুযোগ পাবে। কারণ এই ব্যবস্থায় প্রচুর অর্থ জমা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেটা দুই-এক বছরের মধ্যে হবে না। সিস্টেমটা দাঁড়াতেই তিন থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে। এই ব্যবস্থা শুরু হলে জমা হওয়া অর্থ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের বন্ড বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।'
এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, সরকার বন্ড থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে পারবে। তবে এর ঝুঁকিও রয়েছে। এজন্য শুরুতেই প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো, কঠোর বিধি-বিধান তৈরি করা দরকার। যাতে পেনশন ফান্ডে জমা হওয়া অর্থের কোনো ধরনের অপব্যবহার বা অপচয় না হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় এক সময় ব্যাপক পরিমাণ অর্থ জমা হবে। সেখান থেকে সরকার ঋণ নিতে পারবে। এতে পেনশন তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ যেমন সহজ হবে, তেমনি ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের চাহিদা কমে আসবে।'
তিনি আরো বলেন, একসময় সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিতে চাইতো, মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনতো তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ কম নিতো। সর্বজনীন পেনশনের অর্থ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও মুদ্রাবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরিজীবী এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতদের জন্যও সার্বজনীন পেনশনের দু'টি প্রোডাক্ট তৈরি করা হয়েছে। এ দু'টি প্রোডাক্ট আপাতত চালু করছে না সরকার। কারণ, সরকারি চাকরিজীবীরা বর্তমানে সরকার থেকেই পেনশন পাচ্ছেন। আর স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গ্রাচুইটিসহ অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা এমনভাবে চালু করা হচ্ছে, যাতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও নাগরিকরা আগ্রহী হলে প্রোডাক্ট বা স্কিম পরিবর্তন করতে পারবেন। অর্থাৎ, এখন কোন প্রবাসী ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তিনি পরবর্তীতে আগ্রহী হলে চাঁদার হার বাড়াতে পারবেন এবং তিনি দেশে ফিরে বেসরকারিখাতের কিংবা ইনফরমাল খাতের প্রোডাক্টেও সেটা বদলে নিতে পারবেন।
আবার এখন যিনি অস্বচ্ছল ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন, পরবর্তীতে তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে তিনি প্রোডাক্ট ও চাঁদা- দুটোই বদলাতে পারবেন।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, জুলাই মাসে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা উদ্বোধনের সময় সরকারি চাকরিজীবী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রোডাক্ট দু'টি কোন বছর থেকে চালু হবে, সে ঘোষণা দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ওই সময় থেকে যারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করবেন কিংবা স্বায়ত্তশাসিত বা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিতে চাকরি নেবেন, তাদেরকে এখনকার মতো সরকার থেকে পেনশন সুবিধা দেওয়া হবে না। তখন থেকে যারা চাকরিতে ঢুকবেন, তাদেরও অন্যদের মতো সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং তারা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় পেনশন পাবেন।
কোন বছর থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে, জানতে চাইলে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী চূড়ান্ত করা হবে। তবে ২০৩১ সাল বা তার কাছাকাছি কোন সময় নির্ধারণ করা হতে পারে।
সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আগামী জুলাই মাসের আগেই কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান নিয়োগ দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। যদি এই সময়ের মধ্যে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
সর্বজনীন পেনশন চালু করতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করবে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যেই সমঝোতাগুলোর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এসব এমওইউ সই এবং পেনশন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গেও একটি সমঝোতা স্মারক সই করবে অর্থবিভাগ ও পেনশন কর্তৃপক্ষ। ব্যাংকে জমা হওয়া পেনশনের চাঁদা সঠিক সময়ে সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিত করতে এই এমওইউ করা হবে।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও সমঝোতা স্মারক সই হবে। নাগরিকদের তথ্যভাণ্ডার রয়েছে এই দুই সংস্থায়। বয়স-সহ অন্যান্য তথ্য যাচাইয়ের সুবিধার্থে এই এমওইউ করা হবে।
এছাড়া, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করার প্রস্তুতি নিয়েছে অর্থ বিভাগ। প্রবাসীরা যাতে সহজে এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন সেজন্য এই এমওইউ করা হবে।