ফ্রান্সের ল্যাব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাংলাদেশি লিচু
বাংলাদেশের দিনাজপুরে উৎপাদিত লিচু ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্যানিটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানেটারিসহ ফুড স্ট্যান্ডার্ডের সব শর্ত পূরণ করে প্রথমবারের মতো ফ্রান্সে রপ্তানি হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত ৮ জুন দিনাজপুর থেতে ৩০০ কেজি (১৬,০০০ পিস) লিচুর পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। চালানটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্যানেটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানেটারি এবং অন্যান্য শর্ত যথাযথভাবে পূরণ করার পর, তা প্যারিসসহ ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে বিক্রি হয়। এটিই বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে লিচু রপ্তানির প্রথম ঘটনা।
ফ্রান্সের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এসইউএস প্রাইমশিয়া দিনাজপুর থেকে আরও বেশি লিচু আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় চালানে ২৫,০০০ পিস লিচুর অর্ডার করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কোনো রকম বাড়তি যত্ম ছাড়াই দিনাজপুরের একটি লিচু বাগানের গাছ থেকে তুলে পাঠানো সাধারণ লিচু ইইউ এর স্যানিটারি ও ফাইটোস্যানিটারি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করার ঘটনাকে অত্যন্ত আনন্দের খবর বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, দিনাজপুরের জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।
তারা বলছে, বাংলাদেশের লিচুর ইউরোপ জয়ের এই ঘটনা আগামীতে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লিচুর পাশাপাশি অন্যান্য অ্যাগ্রি প্রোডাক্ট (কৃষিপণ্য) রপ্তানি বাড়ার বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। ইউরোপের মতো বৃহৎ বাজারে যেকোনো কৃষিপণ্য রপ্তানির সুযোগ বাড়লে তা রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে সহায়ক হবে।
অস্ত্র বাদে সকল পণ্য রপ্তানিতে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও কমপ্ল্যায়েন্স ও পণ্যমান নিশ্চিত করতে না পারায়, তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য কোনো পণ্য রপ্তানিতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ। এমনকি প্রসেসড অ্যাগ্রি ফুড রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইউরোপের কঠোর ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। বিভিন্ন সময় পণ্যে ক্ষতিকর উপাদান পাওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের অ্যাগ্রি প্রোডাক্ট ও প্রসেসড ফুড রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে ইইউ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দিনাজপুর থেকে ফ্রান্সে রপ্তানি হওয়া লিচুর ইউরোপের ল্যাবরেটরি টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়ার ঘটনা দেশের অ্যাগ্রি প্রোডাক্ট রপ্তানির ক্ষেত্রে খুবই ইতিবাচক ঘটনা। মন্ত্রণালয় সব সময়ই রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণ ও অ্যাগ্রি প্রোডাক্ট রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
"লিচু রপ্তানির এই ঘটনা ইউরোপের মতো বৃহৎ অর্থনীতিতে আমাদের অ্যাগ্রি প্রোডাক্ট রপ্তানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে লিচু রপ্তানির এই উদ্যোগ নেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মো. মিজানুর রহমান। তিনি নিজেই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এসইউএস প্রাইমশিয়াকে বাংলাদেশ থেকে লিচু আমদানির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ কৃষি বিভাগ ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।
ফ্রান্সের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে আরও লিচু আমদানি করতে আগ্রহী উল্লেখ করে ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মো. মিজানুর রহমান গত ১০ জুন বাণিজ্য সচিব ও কৃষি সচিবকে চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন, 'চলতি মওসুমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লিচু ফ্রান্সে রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।'
চিঠিতে কমার্শিয়াল কাউন্সিলর লিখেছেন, 'লিচু রপ্তানির ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে পচনশীলতা থেকে রক্ষার জন্য হার্ভেস্ট এরপর দ্রুততম সময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছানো এবং দীর্ঘ পথ পরিবহনের উপযুক্ত প্যাকেজিংয়ের ব্যবস্থা করা। পরীক্ষামূলক চালানটি জেলা প্রশাসক বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকায় পাঠান। পরবর্তীতে নিয়মিত রপ্তানির জন্য উপযুক্ত ও সাশ্রয়ী পরিবহন নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে।'
পরিবহনকালে লিচুর পচন ও বিবর্ণ হওয়া থেকে রক্ষার জন্য হার্ভেস্ট পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও সাশ্রয়ী প্যাকেজিং বিষয়ে কৃষি বিভাগ কারিগরি পরামর্শ দিতে পারে বলে মত দিয়েছেন কমার্শিয়াল কাউন্সিলর।
দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক শাকিল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "ফ্রান্সে রপ্তানির জন্য যে লিচু পাঠানো হয়, তা দিনাজপুরের একটি সাধারণ লিচু বাগানের লিচু। এই লিচু উৎপাদনে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমরা বাজার থেকে যেভাবে পাতাসহ লিচু কিনি, সেভাবেই বাগানের গাছ থেকে পাতাসহ লিচু পেড়ে ফ্রান্সে পাঠানো হয়।"
"শুরুতে ১৬,০০০ পিস লিচুর অর্ডার করেছিল ফ্রান্স, যার ওজন ছিল ৩০০ কেজি। আমি দিনাজপুর থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে এয়ারপোর্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। ঢাকায় লিচুগুলো প্যাকেজিং হওয়ার পর ফ্লাইটে প্যারিস পাঠানো হয়েছে। এখন আরও ২৫,০০০-৩০,০০০ পিস লিচুর অর্ডার এসেছে ফ্রান্স থেকে। লিচুসহ দিনাজপুর থেকে যেকোনো পণ্য রপ্তানিতে জেলা প্রশাসন সর্বাত্বক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে," জানান দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক।
দিনাজপুরের বিরল থানার যে বাগানের লিচু ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছে, সে বাগানটির লিজ মালিক মো. আফজাল আলী। টিবিএসকে তিনি বলেন, ফ্রান্সে যে ১৬,০০০ পিস লিচু পাঠানো হয়েছে, তার প্রতিটি লিচুর দাম ৬ টাকা করে পেয়েছেন তিনি। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা তার কাছ থেকে লিচু নিয়ে ফ্রান্সে পাঠিয়েছেন।
আফজাল আলী জানান, তার বাগানে কোনো ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি। জৈব সার দিয়েই লিচুর আবাদ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস এন্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনজুরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, ইউরোপের মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফ্রান্সে লিচু রপ্তানি হওয়ার ঘটনা ইউরোপে বাংলাদেশের ফল রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে লিচু রপ্তানি করে। এবারও ইতোমধ্যে প্রায় ৭৫ টন লিচু রপ্তানি হয়েছে। মওসুম শেষে এটি বেড়ে ১৫০ টন হতে পারে। শুরুতে সোনারগাঁও এর লিচু রপ্তানি হতো। এখন পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অঞ্চলের লিচুও রপ্তানি হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে লিচুর উৎপাদন হয়েছে ২.১০ লাখ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এটি ছিল ১.৮১ লাখ টন।