পিছিয়ে পড়া পাদুকা ও চামড়া শিল্প: কেন কাঁচামালের সুবিধা নিতে পারছে না বাংলাদেশ?
পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে অনেকটাই পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। নিয়মিত কাঁচা চামড়া পাওয়া সত্ত্বে এই অনগ্রসরতা খাতটিতে পর্যাপ্ত মনোযোগ না দেওয়ার চিত্রই সামনে আনে। অথচ রপ্তানি বাজারের প্রতিযোগী দেশগুলো কাঁচামাল সংকটের মধ্যেও উন্নতি করছে।
উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনামের আগে পাদুকা এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি শুরু করা সত্ত্বেও আয়ের দিক থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ভিয়েতনাম যেখানে এই খাত থেকে বছরে আয় করে ২০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে বাংলাদেশের আয় মাত্র এক বিলিয়ন।
প্রতি বছর ঈদুল আজহার পর এ খাতে বাংলাদেশের দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। দুষ্প্রাপ্য পণ্য হলেও, কাঁচা চামড়ার দাম বছরের পর বছর ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
বর্তমানে চামড়ার মূল্য গত এক দশক বা তারও আগের তুলনায় কম। বিশেষত, ঈদুল আজহায় দাম কম হওয়ায় সুবিধাবঞ্চিতরা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হন। কারণ ধর্মীয়ভাবে চামড়া বিক্রির অর্থ সুবিধাবঞ্চিতদের দেওয়ার বিধান রয়েছে।
গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে কোরবানির পশুর দাম যেখানে দ্বিগুণ হয়েছে, সেখানে কাঁচা চামড়ার দাম কমে হয়েছে অর্ধেক। যা বৈষম্যের চিত্র আরো বেশি ফুটিয়ে তোলে।
২০০০ এর দশকের শেষদিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময় বৈশ্বিক ভোক্তারা চামড়াজাত জুতার বিকল্প হিসেবে সিন্থেটিক জুতা বেছে নিতে শুরু করেন। বিষয়টিকে পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
তবে ব্যবসায়ীরা মূল ধাক্কা তখনই খান, যখন তারা ট্যানিং শিল্পের পরিবেশগত মানদণ্ড মানতে বাধ্য হন।
২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারিবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের নতুন ট্যানারি কমপ্লেক্সে স্থানান্তর করা হয়। একইসঙ্গে তাদেরকে অন্যতম শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোর জোট- লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) মানদণ্ড অনুসরণ সংক্রান্ত এই সার্টিফিকেট নিতে হয়। এতে এই শিল্পের জন্য নতুন মাত্রার চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, 'এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন ছাড়া আমরা চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না এবং পরিহাসের বিষয় হল, যে নতুন কমপ্লেক্সে আমরা স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছি, সেখানে সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) ত্রুটিপূর্ণ।'
চীনের একটি কোম্পানি ত্রুটিপূর্ণ সিইটিপি তৈরি করেছে এবং ২০২০ সালে তারা একটি স্থানীয় বিশেষায়িত কোম্পানির কাছে তা হস্তান্তর করে। এই কোম্পানি মূলত সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মিজানুর রহমান বলেন, আজ পর্যন্ত পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি।
তিনি আরো বলেন, 'এই সিইটিপি সাভারের ১৪০টির বেশি ট্যানারিকে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চোখে অসঙ্গতিপূর্ণ করে রেখেছে, যারা আমাদেরকে দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিতেন।'
বিটিআইয়ের মতে, সাভারে স্থানান্তরের আগে, যখন অনেক বিদেশী ক্রেতার জন্য এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন বড় ব্যাপার ছিল না, তখন ফিনিশড চামড়া প্রতি বর্গফুট ২.২৫ ডলার দরে রপ্তানি করা হচ্ছিল। এখন তা ০.৮ থেকে ১.২ ডলারে নেমেছে।
প্রধানত কিছু চীনা এবং ইতালিয়ান ক্রেতা এখনও আছেন, যারা বাংলাদেশ থেকে ফিনিশড ও সেমি-ফিনিশড চামড়া কেনেন।
'কিন্তু তাদের সাথে প্রতি বর্গফুটের জন্য কয়েক সেন্ট নিয়ে দর কষাকষি করতে হয়, যা আমাদের জন্য এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে ফেলেছে' বলে জানান মিজানুর রহমান।
বিটিএ চেয়ারম্যান মো. শাহিন আহমেদ গত মাসে টিবিএসকে জানান, এলডব্লিউজি ২০০৫ সাল থেকে সার্টিফিকেশনের উদ্যোগ নেয়। তারপর থেকে ভারত তার ট্যানারিগুলো সংস্কার শুরু করে। এখন ভারতে সার্টিফিকেট পাওয়া ট্যানারির সংখ্যা ২৫০টি। যেখানে ৪২টি-ই পশ্চিমবঙ্গের। সে তুলনায়, বাংলাদেশের মাত্র দুটি ট্যানারি এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন পেয়েছে আর একটি পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। এই তিন ট্যানারির একটিও সাভারে ছিল না।
মিজানুর রহমান বলেন, ইতালি-ভিত্তিক বিশ্বের শীর্ষ সিইটিপি প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে ট্যানাররা সরকারকে সিইটিপি কার্যকর করতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা এবং মানদণ্ড উপযোগী করতে পরবর্তীতে আরো ২০০-২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেয়।
তিনি বলেন, ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং সিইটিপি ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতের যথাযথ ভূমিকা অনেক ট্যানারকে এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন পেতে সাহায্য করবে এবং তারা চামড়া রপ্তানি থেকে বছরে প্রায় ৪০০-৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে।
মিজানুর রহমান আরো বলেন, 'এই সুবিধা থাকলে আমাদের প্রতিযোগী ট্যানারদের মতো আমরাও প্রতি বর্গফুট চামড়া ২.২৫ ডলারে বিক্রি করতে পারতাম।'
২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় করেছে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে ফিনিশড (প্রক্রিয়াজাত) ও সেমি-ফিনিশড (আধা-প্রক্রিয়াজাত) চামড়া থেকে এসেছে কেবল ১২৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ফিনিশড ও সেমি-ফিনিশড চামড়া রপ্তানি হয়েছিল ৪০০ মিলিয়ন ডলার।
বিটিএর তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় চামড়ার এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন না থাকায়– ক্রেতাদের শর্তের কারণে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকদের অন্য দেশ থেকে সার্টিফাইড চামড়া আমদানি করতে হয়। বছরে চামড়া আমদানিতে ব্যয় হয় ১৫০ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ থেকে কিনে নেওয়া সেমি ফিনিশড চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে ফিনিশিংয়ের পর চীন ফের সেগুলো বেশি দামে বাংলাদেশে রপ্তানি করে। পাশাপাশি চামড়াজাত পণ্যের স্থানীয় বাজারও সম্প্রসারণ হয়েছে দেশটিতে, যেখানে বিপুল চাহিদা রয়েছে।
বিটিএর ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজার – কম দক্ষতা, উচ্চ মূল্য এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধির – একটি দুষ্ট চক্রের মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে, এক কোটি গরু-মহিষ এবং দুই কোটি ছাগল-ভেড়া থেকে আসা বার্ষিক ২৭-৩০ কোটি বর্গফুট চামড়ার উল্লেখযোগ্য অংশ বিক্রি করার জন্য স্থানীয় বাজারও বড় করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিটিএর চেয়ারম্যান শাহিন বলেন, 'কার্যকর সিইটিপি দেশের ৯৫ শতাংশ ট্যানারির জন্য গেম চেঞ্জার হয়ে উঠবে। এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন পাওয়া বিশ্বের অনেক ট্যানারি আমরা পরিদর্শন করেছি। আমাদের বেশিরভাগ ট্যানারির জন্য এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন পাওয়া কঠিন কিছু হবে না।'