বৈদেশিক অর্থায়ন হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান ঋণ পরিশোধের চাপে বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বাড়তে থাকায় – বাংলাদেশের ওপর ঋণ পরিশোধের চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে চলেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-র এক হিসাব অনুসারে, আগামী অর্থবছরে বাহ্যিক উৎস থেকে সরকারের অর্থপ্রাপ্তি ১.৫ বিলিয়ন ডলার কমবে, এবং পরের অর্থবছরে তা কমবে ২ বিলিয়ন ডলার। এতে চ্যালেঞ্জটি আরও গুরুতর রূপ নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিমুখী এই চাপে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা সংকুচিত হবে, ফলে প্রয়োজন অনুসারে তহবিল বরাদ্দও উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হবে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে আসা ইআরডি-র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ রয়েছে। দুই বছর আগেও যার পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার।
ঋণের মূল বা আসলের পরিমাণ হিসাব করলে, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণদাতাদের মোট ৩.৫৭ বিলিয়ন ডলার বা ৩৭ হাজার ১২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।
এটা চলতি অর্থবছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের প্রায় সমান, এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্ধারিত ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকার চেয়েও বেশি। এমনকী পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারের ব্যয়কেও ছাড়িয়ে যাবে এই অঙ্ক।
ইআরডি'র হিসাবে, আগামী দুই অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার ধারণা করা হয়েছে।
বৈদেশিক ঋণের উচ্চ ছাড় ও সে তুলনায় পরিশোধের চাপ কম থাকায়, চলতি অর্থবছরে নেট বা প্রকৃত অর্থায়ন বাড়বে। তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা চলতি অর্থবছরের ৯.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৭.৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে, ফলে আর্থিক প্রতিকূলতায় পড়বে সরকার।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলেন, মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সোফর রেট (সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজার-ভিত্তিক বৈদেশিক ঋণের সুদ হার বেড়েছে। বর্তমান সোফর রেট ৫.০৫ শতাংশ, এর সঙ্গে স্প্রেড যোগ করে বিদেশি ঋণের জন্য বাংলাদেশকে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিতে হয়। এর প্রভাবে সুদ পরিশোধে চাপ বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনিতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দুই বছর আগেও বাজার-ভিত্তিক ঋণের হার ১ শতাংশের কম বা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি ছিল। তখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অনেক বেশি ঋণ নিয়েছে। "সাম্প্রতিক সময়ে যে ঋণগুলো নেওয়া হয়েছে, তার অনেকগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়নি। সুদ পরিশোধ বাড়ছে মূলত আগের নেওয়ার ঋণের জন্য। কারণ সোফর রেট বেড়েছে এবং ভ্যারিয়েবল স্পিড যুক্ত হয়েছে।"
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, "এসব ঋণ তো নেওয়া হয়ে গেছে, ফলে আমাদের শোধ করতেই হবে। ফলে ফিসক্যাল স্পেস বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আরেকটি উপায় হলো- ঋণ চুক্তিগুলোকে পুনরায় নেগোশিয়েট করা যায়। অনেক ঋণের ক্ষেত্রে একটা নির্ধারিত সময়ে পরে এটা করা সম্ভব।"
তার মতে, ঋণ চুক্তি পুনরায় আলোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে – আমরা কি ভ্যারিয়েবল সুদ হারে নাকি ফিক্স রেট সুদ হারে যাব। এছাড়া পুরোটা শোধ করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু, ডলার সংকটের এসময়ে পুরোটা শোধ দেওয়া সম্ভব নয়।"
জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে আগামী দুই বছরে সুদ হার কমবে, এটা আশা করা ঠিক হবে না। তবে চলতি অর্থবছর শেষে সুদ হার বৃদ্ধির প্রবণতা থামবে, এটা আশা করা যেতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে বাজারভিত্তিক ঋণও। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়েছে। এটা কমার কোনো লক্ষণ নেই। কাজেই আমাদের ঋণ পরিশোধের হার বাড়বে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে এখনো জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ অনেক কম।
তিনি বলেন, বাজার ভিত্তিক ঋণ ছাড়াও ফিক্সড রেটের (নির্দিষ্ট সুদ হার) ঋণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অর্থাৎ, ঋণ আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। তাই ঋণ নিতে হবে ভালো প্রকল্পে, যেখান থেকে রিটার্ন আসবে।
ইআরডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছেরে বাংলাদেশ সরকারে উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ এবং বাজেট সহায়তার ঋণের জন্য ১.১৯ বিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করতে হবে। এরপর ২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদ পরিশোধ করতে যথাক্রমে ১.৩১ এবং ১.৪১ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪৯৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৬ জুন তারিখ পর্যন্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের হিসাব ছিল ৯৪৪ মিলিয়ন ডলার।
শুধু সুদ পরিশোধই নয়, আগামী দুই বছরের মধ্যে আসল পরিশোধ বছরে ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা ইআরডির।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ১.৪১৮ বিলিয়ন ডলার। সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৬ জুন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, এর পরিমাণ ছিল ১.৮৪৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ২.৩৭ বিলিয়ন ডলারে।
বেশ কিছু বড় প্রকল্পে গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা শেষ হওয়ার প্রভাবে পরের দুই অর্থবছর আসল পরিশোধ করতে হবে যথাক্রমে ২.৯০ এবং ৩.৩১ বিলিয়ন ডলার।
আগামী অর্থবছরে সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে সুদ-আসল মিলিয়ে মোট পরিশোধের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩.৫৬৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এরপরের অর্থবছর থেকে সুদ ও আসল পরিশোধ ৪ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদ-আসল মিলিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহযোগীদের দিতে হবে ৪.৭২ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ আসল ও সুদ মিলিয়ে পরিশোধ করে ১.৯১৪ বিলিয়ন ডলার। এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে এর পরিমাণ ছিল ২.৭৯০ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে – বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-র কাছ থেকে সোফর রেটে বাজেট সহায়তা নেওয়ার কারণে – সুদ পরিশোধের চাপ আরো বেড়েছে।
বাজেট সহায়তা– সুদ পরিশোধের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের আসল পরিশোধেও চাপ বাড়িয়েছে। এছাড়া, চলতি অর্থবছরে বেশ কিছু বড় প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হচ্ছে। ফলে এসব প্রকল্পে আসল পরিশোধ করতে হবে বলে জানান তারা।
নেট অর্থায়নও কমবে
ইআরডির প্রতিবেদনের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে নেট বৈদেশিক অর্থায়ন বাড়লেও, এরপরের দুই বছরে তা কমে যাবে।
বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় থেকে আসল বাদ দিয়ে নেট অর্থায়ন হিসাব করা হয়।
ইআরডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে নেট অর্থায়ন বেড়ে দাঁড়াবে ৯.৪০৯ বিলিয়ন ডলারে, যা গত অর্থবছরে ছিল ৮.৫৬১ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৫ অর্থবছরে তা কমে যথাক্রমে- ৭.৯২৮ এবং ৭.৪১৩ বিলিয়ন ডলার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণ ছাড় হয় ১০ বিলিয়ন ডলার। এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছে ইআরডি। ইআরডির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় ১১.৭৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। এর পরের দুই অর্থবছরে ছাড় কমলেও তা ১০ বিলিয়ন ডলারের উপরে থাকবে।