জুলাইয়ে ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে রপ্তানি
এ বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের পণ্যদ্রব্য রপ্তানি সন্তোষজনক ১৫.২৬ শতাংশ হারে বেড়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায়। সরকারি তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে ইতিবাচক এ ধারার চিত্র উঠে এসেছে।
জোরালো এই প্রবৃদ্ধির পেছনে, দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য পোশাকের চালান প্রেরণ গতিশীল হওয়া চালিকাশক্তির ভূমিকা রাখে। রপ্তানি বাড়ার ঘটনা দেশের চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকট কিছুটা লাঘব করতেও সহায়তা করবে।
একদিন আগেই, বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই মাসে রেমিট্যান্সে ৬ শতাংশ পতন হওয়ার তথ্য জানায়।
এরপর বুধবার (২ আগস্ট) রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জুলাই মাসে রপ্তানির প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, মোট রপ্তানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান ছিল ৮৬ শতাংশ।
পণ্যদ্রব্য রপ্তানির অন্যান্য খাত – পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও মাছ, কৃষিপণ্য, ভোগ্যপণ্য, চামড়াজাত পণ্য ও নন-লেদার ফুটওয়্যারেও – আগের বছরের তুলনায় ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রপ্তানি বাড়ার ঘটনায় পোশাক রপ্তানিকারকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট শিল্পের ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণের সাথে সরকারি তথ্যের বড় পার্থক্য আছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, রপ্তানির তথ্য নিশ্চিত করতে সরকারি রপ্তানিকারকদের সমিতিগুলোর সাথে সরকারি সংস্থাগুলো একসাথে কাজ করে।
নাম না প্রকাশের শর্তে শীর্ষস্থানীয় একজন রপ্তানিকারক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তার গ্রুপ চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৮৫.৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৩.৬২ মিলিয়ন পিস তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। ২০২২ সালের একই মাসে তারা ৩৭৩.৩৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৪.৯১ মিলিয়ন পিস আরএমজি পণ্য রপ্তানি করেছেন। অর্থাৎ, এখানেই পড়তির একটা সুস্পষ্ট চিত্র উঠে আসে।
এই উদ্যোক্তা আরও জানান, পণ্যের দাম হিসাবে, এসময়ে তাদের রপ্তানি ২৩.৬০ শতাংশ কমেছে। আর পরিমাণের দিক থেকে ২৩.৬৮ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
অর্ডারের ঘাটতির কারণে, বর্তমানে তার সব কারখানায় ২০ শতাংশ কম সক্ষমতায় চালাতে হচ্ছে বলেও জানান। এই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এমন অবস্থা থাকবে বলে ধারণা করছেন তিনি।
এদিকে, ইপিবির তথ্যমতে, নিটওয়্যার ও উভেন আইটেমসহ পোশাক খাত রপ্তানি বাড়ার পেছনে মূল চালিকাশক্তির ভূমিকা রেখেছে। জুলাইয়ে ৩.৯৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের পোশাক রপ্তানি হয়। নিটওয়্যার খাতে হয়েছে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি, যা ২২ শতাংশ বেড়েছে। উভেন পোশাকে রপ্তানিতেও সন্তোষজনক ১১.৫৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি দেখে আমরা খুবই আশ্চর্য হয়েছে; যেখানে এই শিল্পের সমিতি হিসাবে আমরা জানি, ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন)- এ ২০ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।'
কার্যাদেশের অভাবে বেশিরভাগ কারখানাকেই তাদের প্রকৃত সক্ষমতার চেয়ে কম সক্ষমতায় চলতে হচ্ছে। ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আসার ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
হাতেমের সাথে একমত পোষণ করে নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খসরু চৌধুরী বলেন, ইনস্টলড ক্যাপাসিটির চেয়ে ৩০ শতাংশ নিম্ন সক্ষমতায় চলছে প্রায় প্রতিটি কারখানা। অন্যদিকে, বিদেশি ক্রেতারা (বায়ার) আগের বছরের চেয়ে ১২ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কম দাম দিয়েছে। দামের এই ঘাটতি পূরণ করতে হলে, কারখানাগুলোকে আরও বেশি পরিমাণ পোশাক রপ্তানি করতে হবে।
খসরু চৌধুরী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতিরও একজন পরিচালক। তিনি বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সৃষ্ট বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির চাপে গত বছরের জুলাই থেকেই পোশাক রপ্তানিকারকরা টিকে থাকার সংগ্রাম করছে।'
নভেম্বরের পর থেকে ব্যবসায় ইতিবাচক ধারা ফিরবে এমন আশাপ্রকাশ করেন তিনি। তবে বায়ারদের দেওয়া কম দাম রপ্তানিকারকদের মাথাব্যথার কারণ হিসেবে রয়ে যেতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির পতন লক্ষ করেছি। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারগুলোরও দুর্বল অবস্থা। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে, রপ্তানির এসব তথ্য যাচাইবাছাই করতে আমি বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও রপ্তানিকারকদের সমিতিকে একসাথে বসার অনুরোধ করছি।'
অন্যান্য খাতের পারফর্ম্যান্স কেমন
অন্যান্য খাতের মধ্যে, চামড়া, হোম টেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্য রপ্তানিতে নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কৃষিপণ্য রপ্তানি ১৪.৫৩ শতাংশ বেড়ে ৭২.৫৮ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। জুলাই মাসে এখাতের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৭.৫৪ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ তার চেয়ে ৭.৪৬ শতাংশ বেশি হয়েছে ।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে জানান, সার্বিকভাবে এই খাত গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে নেতিবাচক ধারায় ছিল।
'তবে আমরা আশাবাদী, প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর বেশিরভাগেরই সুরাহা হওয়ায় এই অর্থবছরে সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হবে ' - যোগ করেন তিনি।
জুলাইয়ে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি। করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাজারে এ খাতের পণ্য চাহিদা কমে যাওয়াকে এজন্য দায়ী করছেন শিল্পের অভ্যন্তরীণরা।
৪০ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে গত মাসে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হয়েছে ৫৬.৮৩ বিলিয়ন ডলারের, যা এ মাসের জন্য নির্ধারিত ৮৯.২৬ মিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৬.৩৩ শতাংশ কম।
টিবিএসের সাথে আলাপকালে জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফ্যাব্রিকস- এর নির্বাহী পরিচালক রাশেদ মোশাররফ বলেন, 'অনেকদিন ধরেই এ খাতের অবস্থা ভালো না। আবারো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ এই খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে।'
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো প্রধান বাজারগুলোর ক্রেতারা তাদের কার্যাদেশ স্থগিত রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পণ্যদ্রব্য, কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে, এতে হোম টেক্সটাইল খাত আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
'এছাড়া, কারখানায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি সংকট, এসব ইউটিলিটি সেবার ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির মতোন নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছেন হোম টেক্সটাইলের স্থানীয় উৎপাদকরা। এই অবস্থায়, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে উৎপাদকরা ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছেন' বলেও জানান রাশেদ মোশাররফ।
তিনি আরও বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রেতাদের কাছে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য বিক্রি করতেও সমস্যা হচ্ছে।
এদিকে টানা তিন মাস নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মধ্যে থাকার পর 'সোনালী আঁশ'-খ্যাত পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে ২.৭৫ শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জুলাইয়ে এই খাতের রপ্তানি দাঁড়ায় ৬৫.৬৭ মিলিয়ন ডলারে।
এর আগে আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেছিলেন, 'সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২২-২৩) পাটখাত একটি কঠিন সময় পার করেছে, গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় পাট ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট অযৌক্তিকভাবে কাঁচাপাটের দাম বাড়ানোয় যা প্রত্যাশিতই ছিল। এর ফলে, আমাদের কিছু ক্রেতা এখন বিকল্প ফাইবারের দিকে ঝুঁকেছেন।
তিনি বলেন, 'এবছর বাংলাদেশের পাটচাষিরা বাম্পার ফলন পেয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই এতে করে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে।'
এদিকে ৯৮.৭৪ মিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হলেও আগের অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে তা শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ কম হয়েছে। তবে মাসিক রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৯৭.৫৭ মিলিয়ন ডলারের চেয়ে ১.২ শতাংশ বেশি হয়েছে।