ব্যাংকের উচ্চ মুনাফার নেপথ্য রহস্য
চরম ডলার সংকটের মধ্যে দেশের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড স্থবির অবস্থার মধ্যে থাকলেও – ২০২২ সালে দেশের ব্যাংকখাতের নিট (প্রকৃত) মুনাফা বিস্ময়করভাবে ১৮৩ শতাংশ বেড়েছে। তবে মুনাফায় এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে– খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশনে ব্যাংকগুলোকে ডেফারেল সুবিধা। যার ফলে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট বা স্থিতিপত্রে মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ।
গতবছর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ৫০ হাজার কোটি টাকার ডেফারেল বা অতিরিক্ত সময়ের সুবিধা (অতিরিক্ত সময়) নেয়। দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্য আড়াল করে মুনাফা স্ফীত করে দেখাতে তারা এ উপায় গ্রহণ করে।
এসব ব্যাংক হলো – ন্যাশনাল, জনতা, এবি, রূপালী, অগ্রণী, বেসিক, সোনালী, ওয়ান, এনসিসি, ঢাকা, বাংলাদেশ কমার্স, আইএফআইসি, স্ট্যান্ডার্ড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সাউথইস্ট, এবং সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের যে অংশ খেলাপি হয়ে যায় তার বিপরীতে নিদৃষ্ট হারে করতে হয় প্র়ভিশনিং। এসব প্রভিশন করতে হয় মুনাফা থেকে অর্থাৎ প্রভিশনিং করার পর অবশিষ্ট অংশ প্রকৃত নিট মুনাফা। যদিও অধিকাংশ ব্যাংকের নিট মুনাফা নেগেটিভ হওয়ার কথা থাকলেও ডেফারেল সুবিধা ব্যাংকগুলোকে কৃত্রিম মুনাফা বেশি দেখাতে সাহায্য করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে ১৬ ব্যাংককে ডেফারেল সুবিধা দেওয়া হয়, তারমধ্যে কয়েকটিকে এক থেকে ৯ বছর পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এসব বিশেষ ডেফারেল সুবিধার সিংহভাগই নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া ডেফারেলের সুবাদে – চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও গতবছর উচ্চ মুনাফা দেখিয়ে, ব্যাংকের অনেক পরিচালক মালিকরা নিয়েছেন ডিভিডেন্ট বা মুনাফার অংশ ।
উদাহরণস্বরূপ; আগের বছরের তুলনায়- ২০২২ সালে ওয়ান ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত মুনাফা ৮৪.৫ শতাংশ বেড়ে ১৩৯ কোটি টাকা হয়েছে।
১ হাজার ২৪ কোটি টাকার প্রভিশন ডেফারেল পাওয়ার ঘটনা ব্যাংকটিকে উচ্চ মুনাফা দেখাতে সাহায্য করে। ২০২২ সালে তারা বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ট দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে মুনাফা থেকে প্রভিশনের পরিমাণ বাদ দিতে হলে, ব্যাংকটির লোকসান হতো, ফলে কোনো মুনাফাও ঘোষণা করতে পারতো না।
মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোয় বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারান, এতে করে লভ্যাংশের ঘোষণা দেওয়া পরও পুঁজিবাজারে ব্যাংকের ফেসভ্যালুর চেয়ে নিচেই রয়ে যায় তাদের শেয়ারের দর। সোমবার ওয়ান ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ার ৯.৫ টাকায় কেনাবেচা হয়েছে, যখন ফেসভ্যালু হলো ১০ টাকা।
আরেকটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক– ন্যাশনাল ব্যাংক গতবছর সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা পাওয়ার পরেও ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ডেফারেলের অঙ্ক সমন্বয় করলে তারা চরম পুঁজি ঘাটতিতে পড়তো, ফলস্বরূপ ঋণ দেওয়ার সামর্থ্যও থাকতো না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালেও নগদ ডিভিডেন্টের ঘোষণা দেওয়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে– ২০২২ সালে ১৭০ কোটি টাকার প্রভিশন ছাড়ের সুবিধা নিতে হয়েছে।
কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নির্দিষ্ট আর্থিক মানদণ্ড পূরণ করতে পারলে নগদ ডিভিডেন্ট বা লভ্যাংশ প্রদানের অনুমতি পায়।
গতবছর প্রভিশন ছাড়ের সুবিধা নেওয়া সত্ত্বেও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নিট মুনাফা ১২ শতাংশ কমে ২৯৬ কোটি টাকা হয়েছে। তবে ডেফারেলের সুবাদে ব্যাংকটি ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ট ঘোষণা করতে পেরেছে।
প্রভিশন সংরক্ষণে ৮ হাজার ৫০৩ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা পাওয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক ১২৭ কোটি টাকার নিট মুনাফার ঘোষণা দেয়। ডেফারড থাকা অর্থসহ হিসাব করলে– ২০২২ সালে ব্যাংকটিকে লোকসান দিতে হতো।
একইভাবে, প্রভিশনে ডেফারেল সুবিধা না পেলে এই ১৬ ব্যাংকের অধিকাংশই হয় লোকসান দিত, নাহয় তাদের পুঁজি কমতো।
উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে এই ছাড় – ব্যাংকখাতকে উচ্চ মুনাফা দেখানোর সুযোগ দিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের বছর ৫ হাজার ২২ কোটি টাকা হলেও – ২০২২ সালে দেশের ব্যাংকখাতের নিট মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকায়। এছাড়া, মন্দ বা খেলাপি ঋণের বিপরীতে মোট প্রভিশন বরাদ্দ কমেছে ৪২.৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ, ১৫ হাজার ২৯০ কোটি টাকা থেকে তা নেমে আসে ৮ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকায়।
গত বছর খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। যদিও প্রভিশন সংরক্ষণে সেই তুলনায় কম রাখতে দেখা গেছে।
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা।
প্রভিশন ছাড় পাওয়া ব্যাংকগুলো
সরকারি খাতের ঋণদাতাদের মধ্যে এদিক দিয়ে শীর্ষে ছিল জনতা ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি ৮ হাজার ৫০৩ কোটি টাকার প্রভিশনে ডেফারেল সুবিধা পায়– যা আগামী নয় বছরের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। অন্যদিকে, ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা পর্যন্ত ৬ হাজার ৪৭ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা পেয়েছে রূপালী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, সরকারি অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক চার বছরের জন্য ৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা পেয়েছে। ৯ বছরের জন্য ৪ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছে বেসিক ব্যাংক, এবং চার বছরের জন্য ৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকার প্রভিশন ডেফারেল পেয়েছে সোনালী ব্যাংক।
তবে সব ব্যাংকের মধ্যে ডেফারেল সুবিধা পাওয়ায় শীর্ষে ছিল বেসরকারি খাতের ঋণদাতা- ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটিকে ১০ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা দেয়া হয় ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা পর্যন্ত।
প্রভিশন সংরক্ষণে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ৬ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার ডেফারেল পেয়েছে এবি ব্যাংক, পাঁচ বছরের জন্য ১ হাজার ২৪ কোটি টাকার ডেফারেল পেয়েছে ওয়ান ব্যাংক। ২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা পর্যন্ত, এনসিসি ও ঢাকা ব্যাংক যথাক্রমে ৬৮৫ ও ৪৯৮ কোটি টাকার প্রভিশন ডেফারেল পেয়েছে।
২০২৩ সালের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগ পর্যন্ত ডেফারেল সুবিধা পাওয়া অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে – বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ৪২৮ কোটি, আইএফআইসি ৪২০ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ২৯৯ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৭০ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংক ১২১ কোটি এবং সাউথ বাংলা এগ্রিক্যালচার ব্যাংককে ৩৭ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা দেয়া হয়।
এছাড়া, সূত্রগুলো জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ এ সুবিধার আওতায় পদ্মা ব্যাংককে প্রভিশন ছাড় দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকখাতে প্রকৃত প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি; কিন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া নানান সুবিধার কারণে তা কম দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, 'প্রভিশন ঘাটতির ডেফারেল সুবিধা না পেলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বাড়বে। আর মুলধন কমে গেলে তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। কারণ, বিদেশি ব্যাংকগুলো ব্যাংক মূলধনের মান অনুযায়ী ব্যবসা করে। মূলধনে ঘাটতি থাকলে বাণিজ্য অর্থায়নের রেট-ও বেশি হয়।'
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকগুলোকে মুনাফা ঘোষণা করতে হলে অবশ্যই আগে প্রভিশনিং করতে হবে। 'যদিও পুরোপুরি প্রভিশনিং করতে হয়, তাহলে অনেক ব্যাংকের প্রফিটই হবে না। এছাড়া বাজারে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে। যদিও ব্যাংকগুলো দেশের জন্য অনেক কাজ করে যাচ্ছে ফ্রি কস্টে বা কম সুদ হারে।'
বিভিন্ন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ন্যূনতম চার্জ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেমন সরকারের তেল, গ্যাস ও অন্যান্য আমদানির ক্ষেত্রে তারা মূলত নামমাত্র সুদ নেয়। এছাড়া সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খুবই কম সুদ নিয়ে করে থাকে।
'এসব সেবার চার্জ বেশি হলে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি থাকতো না। তাই এ বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে প্রভিশনিং করতে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়।'
তবে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্ক থাকার প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, এতে মন্দ ঋণও কম হবে, একইসঙ্গে প্রভিশনিং কম করতে হবে।
খেলাপি গ্রাহকদের থেকে টাকা আদায়ে জোরালো ভূমিকা রাখা এবং যেসব খেলাপির বিপরীতে মামলা রয়েছে- তা নিষ্পত্তি করতে পারলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছু ব্যাংককে ডেফারেল সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কারণ এটা না পেলে তাদের নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, এছাড়া তাদের অন্যান্য সম্পদের ওপর চাপ তৈরি হয়। তবে ব্যাংকগুলোর প্রভিশনিং ঘাটতি কমিয়ে আনতে নির্দিষ্ট সময় বেধে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে- সংশ্লিষ্ট ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। 'কোনো ব্যাংক যদি প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তবে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার শঙ্কা থাকে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের ওপর। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় আমানত।'
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদের পরামর্শ হলো– এসব সমস্যা সমাধানে একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করা উচিত। এ ধরনের কমিশনের মাধ্যমে এর আগেও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয়েছে।