রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে বড় পতন, রিজার্ভ ধরে রাখার লড়াই আরও কঠিন করে তুলছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের রোববারের (১ অক্টোবর) তথ্যানুসারে, আগস্টে এক মাসে সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মী বিদেশে যাওয়ার পরও গত ৪১ মাসে দেশে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে সেপ্টেম্বর মাসে। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের বাইরে গেছেন রেকর্ড ১১.৩ লাখ কর্মী।
রেমিট্যান্স প্রবাহে এই বড় পতনের দুঃসংবাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে একই দিনে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে প্রাপ্ত পণ্য রপ্তানির তথ্য। ইপিবির তথ্যানুসারে, সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪.৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত পাঁচ মাসে সর্বনিম্ন। যদিও সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় কমে যাওয়ায় দেশের ব্যালান্স অভ পেমেন্টের ওপর চাপ বাড়তে পারে বলে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎসের এই উদ্বেগজনক ধারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও কমিয়ে দিতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আইএমএফের রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতিতে ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ২১.১৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স শুধু বৈদেশিক মুদ্রার গুরুত্বপূর্ণ উৎসই নয়, এগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য চালকও। অন্যতম প্রধান এই আয়গুলোর প্রবাহ কমে গেলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে যেতে পারে। এর ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যেতে পারে।
জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম
সেপ্টেম্বরে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ব্যাংকারদের মতে এর মূল কারণ হচ্ছে, ডলারের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দামে বড় পার্থক্য, আনুষ্ঠানিক দর ধরে রাখতে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ এবং অবৈধ অর্থপাচারের চ্যানেল হুন্ডির চাহিদা বেড়ে যাওয়া।
এর আগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে কম রেমিট্যান্স (১.০৯ বিলিয়ন ডলার) এসেছিল ২০২০ সালের এপ্রিলে, মহামারির শুরুর দিকে। বর্তমানে সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক গতিমন্থরতা চললেও, পরিস্থিতি করোনা মহামারির মতো খারাপ নয়।
কম রেমিট্যান্স প্রবাহ ও বেশি জনশক্তি রপ্তানি একটু অস্বাভাবিক। চলতি বছরের আগস্টে এক মাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ ১.৩৯ লাখ কর্মী রপ্তানি হয়েছে দেশ থেকে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিদেশে গেছেন মোট ৮.৮২ লাখ কর্মী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মীর গন্তব্য ছিল সৌদি আরব (৩৫ শতাংশ)। এরপর সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন মালয়েশিয়া (৩০ শতাংশ), ওমান (১১ শতাংশ), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৮ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (৪ শতাংশ), কুয়েত (৩ শতাংশ) ও কাতারে (৩ শতাংশ)। ২০২২ সালে রেকর্ড ১১.৩৫ লাখ কর্মী গেছেন বিভিন্ন দেশে।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠালে ডলারের দাম পাওয়া যায় ১১৮–১১৯ টাকা। অন্যদিকে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে ২.৫ শতাংশ সরকারি প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ ১১২.৭৫ টাকা দর পাওয়া যায়। ডলারের আনুষ্ঠানিক ও হুন্ডির দামের পার্থক্য সাধারণত ৩-৪ টাকা থাকে, কিন্তু সেই পার্থক্য এখন ৬ টাকায় চলে গেছে। দামের পার্থক্য এত বেড়ে যাওয়ার কারণে রেমিট্যান্স প্রেরকরা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠানোর দিকে ঝুঁকছেন।
রেমিট্যান্স কেন কমছে, জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক টিবিএসকে বলেন, 'কারণগুলো খতিয়ে দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু সময় দরকার।'
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'অ্যাসোসিয়েশন অভ ব্যাংকারস বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাফেদা ডলারের যে দাম ঠিক করছে, তা সবসময় মানা হয় না। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোকে ডলারের বেঁধে দেওয়া দাম মেনে চলতে চাপ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কয়েকটি ব্যাংক বেশি দাম দেওয়ায় সমালোচনার শিকারও হয়েছে। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলোকে ডলারের আনুষ্ঠানিক দর মেনে চলতে হচ্ছে। মূলত এই কারণেই সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা কমে গেছে।'
ডলারের দর বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'এটা আমরা বারবার বলে আসছি। ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম কম হওয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।'
স্বাভাবিক সময়ে দেশে প্রতি মাসে ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সেপ্টেম্বরে প্রায় ৬৫০-৭০০ মিলিয়ন ডলার কম রেমিট্যান্স এসেছে। এদিকে আমদানি কমায় ও রপ্তানি বাড়ায় আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমছিল। গত জুলাইয়ে সার্বিক ব্যালান্স অব পেমেন্টে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলেও, ওই মাসে ভালো রেমিট্যান্স আসায় আমাদের চলতি হিসাবের ব্যালান্সের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল।'
কিন্তু সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশের চলতি হিসাবের ব্যালান্সের অবস্থা আবার খারাপ হবে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, রেমিট্যান্স কমলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে যাবে।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেন, 'দুই-এক মাসের রেমিট্যান্সের ধারা দেখেই রেমিট্যান্স কমছে, তা বলা যাবে না। লম্বা সময় রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।'
ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম না মানায় ১০ ব্যাংককে জরিমানা
নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দরে ডলার কেনাবেচা করায় ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংকগুলোকে পাঠানো এক চিঠিতে জরিমানার কথা জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই ব্যাংকগুলো হলো—সোশ্যাল ইসলামী, আল-আরাফাহ ইসলামী, মার্কেন্টাইল, মধুমতী, মিডল্যান্ড, ব্র্যাক, এক্সিম, প্রিমিয়ার, শাহজালাল ইসলামী ও ট্রাস্ট।
এর আগে বেশি দামে ডলার কেনার অভিযোগ তদন্ত করার পর 'কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না', তা জানতে চেয়ে ব্যাংকগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো সেই নোটিশের জবাব দেয়। কিন্তু 'উত্তর গ্রহণযোগ্য' না হওয়ায় জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, 'জরিমানা মওকুফের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করব নাকি জরিমানা পরিশোধ করে দেব, তা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি।'
নয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রপ্তানি আয়
ইপিবি তথ্যানুসারে, সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি বাবদ ৪.৩১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা চলতি পঞ্জিকাবর্ষের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এর আগে এপ্রিলে রপ্তানি আয় ৩.৯৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
ইপিবির তথ্যমতে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.৩৭ শতাংশ। আগের বছরের সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় ছিল ৩.৯ বিলিয়ন ডলার।
তবে আগস্ট মাসের রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৪.৬১ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল। তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও পাটপণ্যসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের রপ্তানি এই বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে বলে উঠে এসেছে ইপিবির তথ্যে।
জুনের পর থেকেই দেশের রপ্তানি আয় পড়তির দিকে রয়েছে। ব্যতিক্রম ছিল কেবল আগস্ট মাস। জুনে বাংলাদেশ ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে, জুলাইয়ে যা ৪.৫৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক খাত বাদে অন্যান্য প্রধান খাতে—যেমন হিমায়িত ও জ্যান্ত মাছ, কৃষিপণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটপণ্য এবং হোম টেক্সটাইল—রপ্তানি কমে গেছে।
এই সময়ের মধ্যে গত মাসে কেবল তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশের মতো। বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
ইপিবির তথ্যকে অবশ্য বিভ্রান্তিকর মনে করছেন রপ্তানিকারকদের একটি অংশ।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান টিবিএসকে বলেন, 'অনেক কারখানায় রপ্তানি আদেশ কম। ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। তাহলে রপ্তানি বৃদ্ধির এ তথ্য কীভাবে আসছে, বুঝতে পারছি না।'
তিনি আরও বলেন, 'ইউরোপসহ বাংলাদেশের প্রধান গন্তব্যের বাজারগুলোতে আমাদের পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। ফলে দাম কমছে। আগামী তিন-চার মাসে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক টিবিএসকে বলেন, 'ইপিবির এই তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।'