ভুয়া রপ্তানি ও মানি লন্ডারিং ঠেকাতে অটোমেশন জোরদার করছে এনবিআর
ভুয়া রপ্তানি ও এ প্রক্রিয়ায় মানি লন্ডারিং ঠেকাতে কাস্টমস সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যারকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে এই প্রথমবারের মত সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর স্কোপ অব ওয়ার্ক এবং দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এর মাধ্যমে রপ্তানি সংশ্লিষ্ট পক্ষ যেমন ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার, শিপিং এজেন্ট, এনবিআরের কাস্টমস শাখার এক্সপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট (ইজিএম) ডিপার্টমেন্ট প্রভৃতির কোন পক্ষকে কী কাজ করতে হবে, কত সময়ের মধ্যে করতে হবে– তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
এ লক্ষ্যে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ ৪ অক্টোবর (বুধবার) একটি আদেশ জারি করেছে, যা আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে বাস্তবায়ন হবে।
এতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এই নিয়মের ব্যত্যয় করলে বিদ্যমান কাস্টমস আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনবিআরের সূত্র জানায়, এক্ষেত্রে প্রতিটি চালানের জন্য অনিয়মকারী পক্ষকে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা দেওয়ার বিধান রয়েছে।
ওই আদেশে বলা হয়, "রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করা, মানি লন্ডারিং প্রতিহত করা, রপ্তানি প্রক্রিয়ার সময় কমানো এবং নির্ভরযোগ্য রপ্তানি পরিসংখ্যান নিশ্চিত করতে দেশের বিভিন্ন কাস্টমস হাউজ ও কাস্টমস স্টেশনে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে (আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট অটোমেডেট সফটওয়্যার) ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ইজিএমের কাজ সঠিকভাবে পালন করার জন্য ওই স্কোপ অব ওয়ার্ক সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এর ফলে রপ্তানির সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করা সহজ হবে এবং ভুয়া রপ্তানি কমার সুযোগ তৈরি হবে।"
তিনি বলেন, "এই ব্যবস্থা পুরোদমে বাস্তবায়ন হওয়ার পর ভুয়া রপ্তানি বা রপ্তানি সংশ্লিষ্ট গড়মিল ৯০ শতাংশ ঠিক হয়ে যাবে।"
দেশে রপ্তানির তথ্যে প্রতিবছরই বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যায় সংশ্লিষ্ট সরকারি পক্ষগুলোর মধ্যে। এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো'র (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, তা প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার কম।
অন্যদিকে কাস্টমস হাউজগুলোর অটোমেশন কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার সুযোগে এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়মের কারণে ভুয়া এক্সপোর্ট পারমিট (ইএক্সপি) ব্যবহার এবং ভুয়া রপ্তানির অভিযোগও নতুন নয়।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে ১০ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশে ৩০০ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে অভিযোগ তোলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইআইডি)।
এরপর ওই রপ্তানিকারকদের অনেকেই জানান, আলোচ্য রপ্তানির বিষয়ে তাদের কিছুই জানা নেই। এটি সঠিকভাবে পরীক্ষা করার দায়িত্ব ছিলো কাস্টমস কর্তৃপক্ষে'র।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) গত ২৬ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তার চার সদস্য প্রতিষ্ঠানের (অভিযুক্ত) পক্ষ নিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অভিযুক্ত করায় বরং কাস্টমস কর্তৃপক্ষকেই তিরস্কার করে।
এমন পরিস্থিতিতে এনবিআর আলোচ্য আদেশটি জারি করলো।
এনবিআরের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, "ওই আদেশের আলোকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সঠিকভবে দায়িত্ব পালন করলে রপ্তানি সময় কমবে, সহজ হবে এবং মানি লন্ডারিং সহ অনিয়ম কমবে।"
"তবে কোন পক্ষ যাতে এই আদেশকে পুঁজি করে অন্যায় সুবিধা না নিতে পারে বা হয়রানি না করে, সেটিও নিশ্চিত হওয়া দরকার", বলেন তিনি।
আরএমজি মালিক সংগঠনের আরেকজন শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "সিদ্ধান্তটি ভালো, তবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামতের ভিত্তিতে এটি ঠিক করা দরকার ছিলো।"
ঢাকায় অবস্থিত একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য বিভাগের এক সিনিয়র কর্মকর্তাও এমন উদ্যোগকে 'ইতিবাচক' বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, "এর ফলে এখন থেকে শৃঙ্খলা আসবে। ভুয়া রপ্তানি বা রপ্তানির হিসাবে গড়মিল থাকার সুযোগ কমে যাবে।"
তিনি বলেন, নতুন এ পদ্ধতিতে যেহেতু সব পক্ষের কাজ এবং টাইম ফ্রেম ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, ফলে এখন যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে।
যার যে দায়িত্ব
নতুন স্কোপ অব ওয়ার্ক অনুযায়ী সি বাউন্ড এক্সপোর্ট এর ক্ষেত্রে সিএন্ডএফ এজেন্টকে অন্তত ৮টি বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। একইভাবে শিপিং এজেন্টকে ৮টি, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারকে ৮টি ও কাস্টম বিভাগকে ৫টি, প্রাইভেট আইসিডি অথরিটি কে ৪টি দায়িত্ব নিতে হবে। এর বাইরে এয়ার এবং ল্যান্ড-এ রপ্তানির ক্ষেত্রেও একইভাবে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা বলেন, যেসব বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সবই পুরনো। কিন্তু কার কী দায়িত্ব তা সুনির্দিষ্ট করা ছিলো না বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা ছিলো। এখন আর তা সম্ভব হবে না।
সিএন্ডএফ এজেন্টকে যেসব দায়িত্ব পালন করতে হবে, তা হলো অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারে সঠিক তথ্য দিয়ে বিল অব এক্সপোর্ট জমা দেওয়া, বিল অব লেডিং এ ক্যারিয়ার কোড ও নাম অন্তর্ভুক্ত করা, প্রযোজ্য তথ্য ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোর রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি নিশ্চিত করা, এনবিআরের সফটওয়্যারে জমা দেওয়া পণ্যের বিস্তারিত বিবরণে কোন গড়মিল দেখা গেলে কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক অ্যাসেসমেন্টের আগেই সংশোধন নিশ্চিত করা, সেখানেও কোন ভুল দেখা গেলে তা শিপমেন্ট এর আগে ও ইজিএম ক্লোজ করার আগে সংশোধন করা এবং দ্রুত এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সরবরাহ করা।
এছাড়া কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শিপমেন্ট এর পর জাহাজ বন্দর ত্যাগ করার তিন দিনের মধ্যে কাস্টমস সফটওয়্যারে ইজিএস ক্লোজ করবে। শিপিং এজেন্ট কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ে ইজিএম দাখিল করা না হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।