ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য কমে দাঁড়িয়েছে ১.৭৪ লাখ কোটি টাকায়
কন্ট্রাকশনারি মনেটারি পলিসি গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
ইতোমধ্যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেওয়ার জন্য টাকা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে, সরকারও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ফেরত দিচ্ছে, যা থেকে বাড়ছে তারল্য সংকট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে ১.৭৪ লাখ কোটি টাকা। জুলাই মাস শেষে এর পরিমাণ ছিল ১.৮০ লাখ কোটি টাকা।
সেপ্টেম্বর শেষেও এক্সেস লিকুইডিটি কমার ধারায় আছে বলে জানা গেছে।
এসএলআর ও সিআরআর ঠিক রাখার পর অতিরিক্ত তারল্য গণনা করা হয়। নগদ আকারে মোট আমানতের ৪% সিআরআর এবং নগদ-বহির্ভূত আকারে ১৩% এসএলআর বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা ব্যাংকগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক।
তবে অতিরিক্ত অর্থ সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা থাকে যার মাধ্যমে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ধার করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন রিজার্ভ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৭০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করছে। এর ফলে প্রতিদিন গড়ে ৭৭৪ কোটি টাকা মার্কেট থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঢুকছে। ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা তারল্য কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে রিজার্ভ থেকে ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এসব ডলার বিক্রির ফলে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো তারল্যের চাপে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে সরকার বন্ড ও ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ২৫,৭০৯ কোটি টাকা ধার করেছে, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ২৯,৪৮৭ কোটি টাকা শোধ করেছে।
অর্থাৎ, সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে টাকা ধার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার পরিশোধ করছে; যেটি আদতে মানি সাপ্লাই কমিয়ে দিচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ধারকে বিবেচনায় নিলে তিন মাসেই দেশের মানি সাপ্লাই থেকে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে চলে গেছে।
ব্যাংকগুলোও প্রাইভেট সেক্টরে লোন দেওয়ার তুলনায় ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগকে তুলনামূলক লাভজনক মনে করছে। এর অন্যতম কারণ, এসব বিল ও বন্ডের ইন্টারেস্ট রেট প্রায় ২০০ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে যাওয়া।
৯১ দিনের ট্রেজারি বিল অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ৭.৪৫% হারে বিক্রি হয়েছিল। এরপর ৯ অক্টোবর সর্বশেষ নিলামে একই সময়ের ট্রেজারি বিলের বিপরীতে সর্বাধিক ৯.২৫% হারের প্রস্তাব করা হয়।
লিকুইডিটি স্ট্রেস বেড়ে যাওয়ার একটা প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেপো, স্থায়ী ঋণ সুবিধা এবং তারল্য সহায়তা সুবিধা এবং ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সুবিধার মাধ্যমে টাকা ধার দেওয়ার প্রবণতা বিবেচনার মাধ্যমে। চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন গড়ে ১৪০০০-১৮০০০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। গতমাসেও এর পরিমাণ ১০ হাজার কোটির নিচে ছিল। ব্যাংকগুলোতে লিকুইডিটি স্ট্রেস বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শর্ট টার্মে এসব টাকা ধার করা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া ব্যাংকগুলোতে লিকুইডিটি স্ট্রেস বেড়ে যাওয়ার কারণে এক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকে ওভারনাইট ধার দেওয়ার ইন্টারেস্ট রেট হিসাবে পরিচিত কলমানি রেটও আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। গত ১৮ অক্টোবর এটি এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭.৭২% এ পৌঁছেছে। অক্টোবরের শুরুর দিকেও এটি ৬.৫০% এর আশেপাশে ছিল।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "ব্যাংকগুলোতে লিকুইডিটি স্ট্রেস তৈরি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কন্ট্রাকশনারি মনেটারি পলিসি নেওয়ার মাধ্যমে ইনফ্লেশনকে কন্ট্রোল করতে চাচ্ছে।"
অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ইনফ্লেশনকে কন্ট্রোল করা প্রধান লক্ষ্য হওয়াই উচিত বলে মন্তব্য করেন এই ব্যাংকার।
তবে ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব ব্যাংক এখনো লিকুইডিটি স্ট্রেসে পড়েনি। যেসব ব্যাংক ডিপোজিট বেশি পাচ্ছে, তাদের লিকুইডিটি স্ট্রেস এখনো তৈরি হয়নি। তবে খারাপ অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলো বেশি চাপে থাকায় এর প্রভাব ভালো ব্যাংকগুলোতেও পড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।