ডাবল কাউন্টিং: রপ্তানির হিসাব বেশি হওয়ার নেপথ্য রহস্য
রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের রপ্তানির পরিমাণে ভুল হিসাব করা হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে বেশি দেখানো হচ্ছে রপ্তানি। বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন।
এই সমস্যাটি 'ডাবল কাউন্টিং' নামে পরিচিত। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ এই সমস্যায় ভুগছে। কারণ রপ্তানিকারকরা স্থানীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলো (ইপিজেড) থেকে যে পণ্য ও অ্যাকসেসরিজ কেনে, তা দুইবার রপ্তানির হিসাবের মধ্যে আসছে—একবার রপ্তানিকারকের রপ্তানি হিসেবে, আরেকবার ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি হিসেবে।
স্টেকহোল্ডাররা বলছেন, রপ্তানির ডাবল কাউন্টিংয়ের ফলে দেশের রপ্তানির পরিমাণ বেশি দেখাচ্ছে। এতে রপ্তানি খাতের প্রকৃত পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, এনবিআর ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে রপ্তানির পরিসংখ্যান হিসাব করায় এই বিভ্রান্তিকর তথ্যের সৃষ্টি হয়েছে।
রপ্তানির ডাবল কাউন্টিং ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি পরিসংখ্যানের মধ্যে বড় ব্যবধানের কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এর মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে আসেনি।
স্টেকহোল্ডারর বলছেন, দেশে না আসা রপ্তানি আয়ের মধ্যে ডাবল কাউন্টিংয়ের অংশও রয়েছে।
ডাবল কাউন্টিংয়ের ব্যাপারটি নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশনস লিমিটেডের উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে প্রায় ১,০০,০০০ ডলারের গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ কিনেছে ইপিজেড থেকে, যা দিয়ে পোশাক তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি করেছে। এই অ্যাকসেসরিজের খরচসহ রপ্তানিকৃত পোশাকের মূল্য এমবি নিট ফ্যাশনসের রপ্তানির হিসাবে যুক্ত হয়েছে; আবার যে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা অ্যাকসেসরিজ কিনেছে, ওই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির হিসাবেও যুক্ত হয়েছে।
এভাবে শত শত কোম্পানির রপ্তানি এই পদ্ধতিতে ডাবল কাউন্ট করা হচ্ছে। এই সংখ্যাটি বেশ বড়।
ইপিবির প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে স্থানীয় রপ্তানি কোডের মাধ্যমে রপ্তানি হয়েছে ১.৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই পরিমাণ রপ্তানির অর্থ ডাবল কাউন্ট হয়েছে এবং তা বছরের পর বছর ধরে চলছে বলে উল্লেখ করছেন স্টেকহোল্ডাররা।
ইপিবির তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডাবল কাউন্টের পরিমাণ ছিল ১.০৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ছিল ০.৪৯ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইপিজেডের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য ক্রয় করলে তা উভয় প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি হিসেবে কাউন্ট করা হচ্ছে, যা প্রকৃত রপ্তানির তথ্য নয়। মূল রপ্তানি হিসাব করার ক্ষেত্রে যেকোনো একটি বাদ দিতে হবে।'
'ধরা যাক, ইপিজেডের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৬০ হাজার ডলারের কাঁচামাল কিনে আমি সেখানে আরও ৪০ হাজার ডলারের ভ্যালু অ্যাড করে ফিনিশড পণ্য ১ লাখ ডলারে রপ্তানি করি। তাহলে আমার রপ্তানির হিসাবে ১ লাখ ডলার দেখানো হয়। আবার ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির হিসাবেও ৬০ হাজার ডলার দেখানো হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশ থেকে তো রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ডলার,' বলেন তিনি।
একইভাবে বাইরের প্রতিষ্ঠান ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য বা অ্যকসেসরিজ বিক্রি করলেও সেটি ডাবল কাউন্ট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন হাতেম।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি আরও বলেন, বিদেশে রপ্তানি হওয়া পণ্যে কোনো কারণে ছাড় (ডিসকাউন্ট) দিতে হলে, শিপমেন্ট হওয়ার পর ক্রেতা পণ্য গ্রহণ না করলে এবং কোনো পণ্য দেশে ফেরত এলে তা-ও রপ্তানির তথ্য থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, গত অর্থবছরে পণ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্যে ছাড় দিতে হয়েছে কিংবা প্রত্যাখ্যান হয়েছে। কিন্তু ওই ৫০০ মিলিয়ন ডলারও রপ্তানির হিসাবে যুক্ত ছিল। 'এটা প্রকৃত অর্থে রপ্তানির হিসাবে থাকা উচিত নয়,' বলেন তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলোর রপ্তানি ডাবল কাউন্ট হচ্ছে। এর বাইরেও রপ্তানি হওয়ার পর ডিসকাউন্ট দিতে হলে কিংবা ওই পণ্য ফেরত এলেও তা মূল রপ্তানির হিসাবের সময় বাদ দেওয়া হচ্ছে না। যথাযথ হিসাবের স্বার্থে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আলোচ্য কারণগুলো বিবেচনায় নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানির হিসাবের সঙ্গে ইপিবির হিসাবের এত বড় ব্যবধান হওয়ার কথা নয়। দীর্ঘ সময়ে এই ব্যবধান কমে আসার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে অনৈতিক কিছু হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
ডাবল কাউন্টিং কেন হচ্ছে?
ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়ভাবে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ১০ শতাংশ বিক্রি করতে পারে। এই বিক্রিও রপ্তানি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ পণ্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে, সেই তথ্য ইপিবি দিতে পারেনি।
কর্মকর্তারা বলছেন, আলোচ্য সব ধরনের রপ্তানি একই কোডের আওতায় হিসাবভুক্ত করে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ, যার ফলে ডাবল কাউন্টিং হয়ে যাচ্ছে।
তবে এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, তারা যে তথ্য দিচ্ছেন, তা ইপিবি চাইলে আলাদা করে প্রকৃত রপ্তানির হিসাব দেখাতে পারে। কিন্তু ইপিবি সেটি কেন করছে না, তা স্পষ্ট নয়।
এনবিআরের এমন বক্তব্য অবশ্য মানতে নারাজ ইপিবি কর্মকর্তারা।
ইপিবির পরিচালক কুমকুম সুলতানা বলেন, আইনগতভাবে তথ্য আলাদা করার সুযোগ নেই; সেজন্যই ইপিবি আলাদা হিসাব দেখাতে পারছে না। তিনি বলেন, বিল অভ এক্সপোর্টের ভিত্তিতে কাস্টমসের মূল্যায়ন অনুযায়ী রপ্তানির যে তথ্য তাদের দেওয়া হয়, তার ওপর ভিত্তি করেই তাদেরকে তথ্য সংকলন (কমপাইল) করতে হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুর রহিম বলেন, ডাবল কাউন্টিংয়ের যে হিসাব বলা হচ্ছে, তা খুব বেশি হবে না।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ইপিবির রপ্তানির তথ্যে বিশাল ব্যবধান কেন, এর কারণ খুঁজতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এত বড় গ্যাপ কেন হচ্ছে? নিশ্চয় অন্য কোনো কারণ আছে। আমরা বিষয়টি ফাইন্ড আউট করতে কাজ করছি।'
এনবিআরের উদ্যোগ
এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ চলতি মাসের শুরুর দিকে রপ্তানির ডাবল কাউন্টিংয়ের সমস্যা নিয়ে একটি সভা করেছে। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ইপিজেডের রপ্তানিসহ যেসব রপ্তানি ডাবল কাউন্ট হচ্ছে, তা আলাদা কোডে দেখানো হবে।
ওই সভায় উপস্থিত এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, 'সভায় আমাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, রপ্তানির ডাবল কাউন্ট এড়াতে সব রপ্তানি একই কোডে হিসাবভুক্ত করা হবে না।'