উন্নয়ন প্রকল্পের থোক বরাদ্দ থেকে ব্যয় বন্ধ করল সরকার
আর্থিক চাপের মধ্যে ব্যয় কমাতে এবং বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন কাজের থোক বরাদ্দ থেকে ব্যয় না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জুলাইয়ে অর্থবছরের শুরু থেকেই কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচির আওতায় ব্যয় কম করার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে মোটরযান, আকাশযান ও জলযান কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ, ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে অংশগ্রহণও বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণও।
৩১ অক্টোবর অর্থ বিভাগ থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়ে পরিকল্পনা কমিশন এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতাধীন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর 'বিশেষ প্রয়োজনের' জন্য রাখা থোক থেকে কোনো বরাদ্দ না দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বাজেট প্রণয়নের সময় বিশেষ বিবেচনায় উন্নয়ন ও পরিচালন বাজেটে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে থোক হিসেবে ৩৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে উন্নয়ন বাজেটের থোক বরাদ্দের পরিমাণ ২৩ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা—৪ হাজার ৬৯৭ কোটি বরাদ্দ পরিকল্পনা কমিশনের জন্য এবং ১৯ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য।
অর্থ বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় হচ্ছে না। আবার নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়ন কাজের জন্য থোক থেকে বরাদ্দের চাহিদাও বেশি। কিন্তু সরকার বাড়তি ঋণ নিয়ে ব্যয় করতে চাচ্ছে না। বাজেট ঘাটতি সরকার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই রাখতে চায়। এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার হাতে বাড়তি অর্থও রাখতে চায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের(এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) ৭৬ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহ ১৪.৩৪ শতাংশ বেশি হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম।
বিশ্লেষকরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তারা বলছেন, রাজস্ব সংগ্রহ কম হওয়ায় সরকার ঋণের চাপে রয়েছে। এ সময়ে বাড়তি খরচ না করা গেলে সরকারের চাপ কিছুটা হলেও কমবে।
সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি
অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকার কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচির আওতায় ব্যয় কম করার পদক্ষেপ নিয়েছে।
গত ২ জুলাই এক পরিপত্রে অর্থবিভাগ পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাবদ ব্যয় ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম করার নির্দেশনা দেয়। এছাড়া মোটরযান, আকাশযান ও জলযান ক্রয়, সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ, ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে অংশগ্রহণও বন্ধ রাখা হয়েছে।
এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ১৩ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
পরিপত্রে অর্থ বিভাগ বলেছে, ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দের অর্থ ব্যয়ের বেলায় অর্থ বিভাগের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।
এর ফলে উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। এ অচলাবস্থা নিরসনে ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি স্পষ্ট করে আরেকটি পরিপত্র জারি করে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণের অচলাবস্থা দূর করা হবে।
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, সংশোধিত বাজেটের আগে উন্নয়ন বাজেটে থোক বরাদ্দের অর্থ সাধারণত ব্যবহার হয় না। এ বছরও ব্যয় হয়নি। সাধারণত প্রতি বছর ডিসেম্বরে বাজেট সংশোধনের কাজ শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়। তবে আসন্ন নির্বাচনের কারণে এবারের বাজেট সংশোধনের কাজ মার্চে শেষ হবে। ফলে মার্চের আগে উন্নয়ন বাজেটে থোক বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা নেই।
বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, থোক বরাদ্দ সাধারণত নিরুৎসাহিত করা হয়, কারণ এ অর্থ অপব্যবহারের এবং স্বচ্ছতার অভাব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, 'সরকার যদি থোক বরাদ্দের উপর নির্ভর না করে কাজ পরিচালনা করতে পারে তবে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে।'
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানও নির্বাচনের আগে থোক বরাদ্দ থেকে টাকা না নেওয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সম্পদের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ রাজস্ব আয় সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী হবে না। সেক্ষেত্রে সরকারকে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযত হতে হবে। কারণ ঋণ করে এখন এ ধরনের ব্যয় করা হলে সেটি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।
থোক বরাদ্দ: ব্যবহার ও সমালোচনা
অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং পরিচালন ধারাবাহিকতা ধরে রাখা নিশ্চিত করতে থোক বরাদ্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এছাড়াও সংসদ সদস্যদের (এমপি) তাদের নির্বাচনী উন্নয়ন উদ্যোগকে সহায়তা দেওয়ার জন্যও থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। থোক বরাদ্দ রাখার উদ্দেশ্য স্থানীয় চাহিদা ও অগ্রাধিকারগুলো সরাসরি মেটাতে এমপিদের সহায়তা করা।
তবে স্বচ্ছতার অভাবের জন্য থোক বরাদ্দের ব্যবহার নিয়ে সমালোনা হয়েছে। থোক বরাদ্দের অর্থ ব্যয় নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
অভূতপূর্ব স্বাস্থ্য সংকটের জন্য মহামারিকালে বড় অঙ্কের থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। মহামারি মোকাবিলা-সংক্রান্ত অপ্রত্যাশিত ব্যয় মেটানোর জন্য সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করে।
অর্থবছরের মূল বাজেটে উন্নয়ন খাতে থোক বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ১৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা করা হয়।