বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর এসব প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রাক্কলন অনুসারে, ২০২৬ সালের পর রূপপুর পারমাণকি বিদ্যুৎ প্রকল্পে নেওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে। এতে ঋণ পরিশোধের বোঝা আরও অনেকটা বাড়বে।
ইআরডির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঋণের আসল পরিশোধ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে আসল পরিশোধ করতে হবে ২.৯ বিলিয়ন ডলার, যা এর পরের অর্থবছরে বেড়ে হবে ৩.৩১ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ১.৭৩ বিলিয়ন ডলার।
তেরো বছর আগে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে, মোট ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার—এর মধ্যে আসল ৬৮৬ মিলিয়ন ডলার ও সুদ ছিল ১৯০ মিলিয়ন ডলার।
সরকার বিলিয়ন ডলারের বেশ কিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করায় চলতি অর্থবছরে সুদসহ বিদেশি ঋণ পরিশোধের বোঝা ১.১৯ বিলিয়ন ডলার বাড়বে। আর পরের দুই অর্থবছরে তা যথাক্রমে ১.৩১ বিলিয়ন ডলার ও ১.৪১ বিলিয়ন ডলার বাড়বে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন যে এসব ঋণের টেকসই হওয়াটা নির্ভর করছে বাংলাদেশের এই বৃহৎ পরিসরের প্রকল্পগুলোর সুফল আদায় এবং স্থানীয় উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সক্ষমতার ওপর।
উদাহরণ দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর যদি বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে না পারে, তাহলে এই ঋণ পরিশোধের বোঝা উল্লেখ্যযোগ্য হারে বেড়ে যাবে। একইভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের সাফল্যও নির্ভর করছে টানেলের আশপাশের এলাকায় প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো স্থাপন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সক্ষমতার ওপর।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, মেগা প্রকল্পের ওপর সরকারের বর্তমান মনোযোগের ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এই চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে; কারণ এসব প্রকল্প থেকে উল্লেখযোগ্য আয়ের সম্ভাবনা নেই। এসব ঋণের আসল পরিশোধ শুরু করার কারণে দেশ বড় আর্থিক বোঝার মুখে পড়তে পারে।
বিষেশজ্ঞদের মতে, গত অর্থবছর থেকে আর্থিক হিসাবে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সেটি আগের মতো উদ্বৃত্তে আনার পথে ঋণের আসল পরিশোধ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। একের পর এক বড় ঋণগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ার কারণে আর্থিক হিসাবে আসল পরিশোধ আগামীতে বাড়তেই থাকবে।
তারা বলছেন, ঋণের আসল পরিশোধের চাপ মোকাবিলায় সরকারকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের অর্থছাড় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে দিবে। তবে আগামী বছরগুলোতে অর্থছাড় বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হবে বলে উল্লেখ করেন তারা।।
সূত্রমতে, এর আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থছাড় কমেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে ৯.২৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
আসল পরিশোধ আরও বাড়বে
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২.৬৬৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি হয় ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল। এই ঋণের পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে গত এপ্রিলে। ফলে চলতি অর্থবছর থেকে এ ঋণের আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। ১৫ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
২০২৭ সাল থেকে রূপপুর পারমাণকি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নেওয়া ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ শুরু করবে বাংলাদেশ। ২০ বছর মেয়াদের এ ঋণের জন্য প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আসল পরিশোধ করতে হবে।
ওই একই সময়ে মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ঋণের আসল পরিশোধও শুরু হবে। তখন বার্ষিক আসল পরিশোধ ৪.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যাবে।
এর ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে আসল পরিশোধে আরও বড় উল্লম্ফন হবে।
চাপ বাড়াবে বাজেট সহায়তার ঋণ
করোনা মহামারি পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে সরকার গত কয়েক বছরে বেশ কিছু বাজেট সহায়তা নিয়েছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, মহামারির শুরু থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ৬.৪৬ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু বাজেট সহায়তা ঋণের গ্রেস পিরিয়ড তিন বছর; ঋণ পরিশোধের সময় ১২ বছর।
ইতিমধ্যে এ ধরনের কিছু বাজেট সহায়তা ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) ২৫০ মিলিয়ন ডলার এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ২৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা। এ দুটি ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে গত মে মাসে।
এছাড়া আগামী জুনে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের আরও একটি বাজেট সহায়তার গ্রেস পিরিয়ড শেষ হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ১.০৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
ফলে আগামী দু্ই-তিন বছরে বাজেট সহায়তা ঋণ পরিশোধ চাপ তৈরি করবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
আসল পরিশোধ শুরু হতে যাচ্ছে যেসব বড় ঋণের
সরকার ডিপিডিসি প্রকল্পের আওতায় পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণের জন্য ২০১৯ সালের ৪ জুলাই চীনের কাছ থেকে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। এই ঋণের গ্রেস পিরিয়ড আগামী জুনে শেষ হবে। ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ সময় পাবে ১৫ বছর।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে টানেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই। এ প্রকল্পের ৪০৫ মিলিয়ন ডলার ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় গত অর্থবছর থেকে আসল পরিশোধ শুরু হয়েছে।
রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের জন্য এডিবি থেকে নেওয়া ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে গত আগস্টে। এছাড়াও এডিবির আরও কয়েকটি বড় আকারের ঋণের গ্রেস পিরিয়িড শেষ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রেলওয়ে রোলিং স্টক অপারেশনস ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের জন্য নেওয়া ২৭৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ, সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) ট্রাঞ্চ-৩-এর জন্য নেওয়া ২২৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ, সাউথ-ইস্ট ট্রান্সমিশন গ্রিড এক্সপ্যানশন প্রকল্পের জন্য নেওয়া ৩৫১ মিলিয়ন ডলার ঋণ এবং ফোর্থ প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের জন্য নেওয়া ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ।