শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ে বিপাকে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪ ব্যাংক
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক তাদের শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছ থেকে ১১৯ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে; যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২,১৯০ কোটি টাকার তুলনায় মাত্র ৫.৪৩ শতাংশ।
চলমান অর্থনৈতিক স্লথগতি ও ঋণ বিতরণকালে নানান অনিয়ম হওয়ায় এমনটি ঘটেছে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা।
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক– অগ্রণী, জনতা, সোনালী এবং রূপালীর শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে পাওনা রয়েছে ২৩,৪২১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে নানান অনিয়ম থাকায় এসব ঋণ কিছুদিন পরেই খেলাপি হয়ে যায়।
"খেলাপি ঋণ আদায়ে যতই পরিকল্পনা নেওয়া হোক, প্রকৃত গ্রাহক না থাকায় ঋণ আদায় অসম্ভব। প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণে আরও সতর্ক হওয়া উচিত এবং একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ তদারকি বাড়ানো উচিত," বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে পাওনা রয়েছে ৮,৭৩৯ কোটি টাকা; যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের ৫৮ শতাংশ।
জনতা ব্যাংকের চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে খেলাপি ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে ৮৭০ কোটি টাকা; অথচ ব্যাংকটির আদায় হয়েছে মাত্র ১৬ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২ শতাংশ।
এদিকে, জনতা ব্যাংকের ক্যাশ রিকভারি ফ্রম রাইট-অফ লোনের (অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায়) জানুয়ারি-জুন সময়ে টার্গেট ছিল ৩৩০ কোটি টাকা; কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এইখাত থেকে আদায় করেছে মাত্র ২৮ কোটি টাকা বা ৮ শতাংশ।
জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুস সালাম বলেন, "আসলে ব্যাংকের যে পরিমাণে খেলাপি ঋণ রয়েছে, তার ওপরে বড় একটি অংশ নির্ধারণ করে দেয় রিকভারি করার জন্য। ব্যাংকগুলো যে পরিমাণে আদায় করছে, তা খুবই সীমিত, কারণ এখন নির্বাচনপূর্ব ব্যবসায়িক কার্যক্রম অনেকটা স্লথগতিতে যাচ্ছে। যার কারণে গ্রাহকরা ঋণ শোধ করতে পারছেন না।"
তিনি আরও বলেন, "কিছু কিছু ঋণ এমন খাতে যায় যা আদায় করা খুবই কঠিন। সেক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার সময় আরও সতর্ক থাকতে হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকের ঋণ রিকভারি কমিটিকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।"
এছাড়া, গত এক বছরে বৈশ্বিক যুদ্ধ অবস্থায় অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা খারাপ হওয়ায়ও খেলাপি ঋণ পরিশোধ কমেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাইট-অফ বা অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের হার খুবই কম– এ বিষয়ে তিনি বলেন, "ঋণ রাইট-অফ করা হয় এমন পর্যায়ে যখন সেই ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থাকে। এরজন্য আইনীভাবে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে; একইসঙ্গে গ্রাহকের জামানত হিসেবে রাখা সম্পদ বায়জাপ্ত করা, কিংবা বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে। পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হলে খেলাপি গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে আরও সতর্ক হবেন।"
প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে পাওনা রয়েছে ৬,৮৫৪ কোটি টাকা; যা তাদের মোট খেলাপি ঋণের ৪৫ শতাংশ।
অগ্রণী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এমওইউ অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে খেলাপি ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে ৬৮৫ কোটি টাকা; অথচ ব্যাংকটি আদায় করেছে মাত্র ১২ কোটি টাকা বা ২ শতাংশ।
একইসঙ্গে, অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশ রিকভারি ফ্রম রাইট-অফ লোন থেকে জানুয়ারি-জুন সময়ে টার্গেট ছিল ৪০০ কোটি টাকা। অথচ প্রতিষ্ঠানটি এইখাত থেকে আদায় করেছে মাত্র ১৯ কোটি টাকা বা ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "এখন ব্যাংকাররা অনেকটা বড় ঋণখেলাপিদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। দয়া করে কিছু দিলে পেল, না দিলে কিছু করার নেই।"
তিনি বলেন, "এছাড়া বছরের পর বছর ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে থাকায় ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও কমে যায়। বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনেও অসুবিধার মুখে পড়ে।"
"ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো গ্রাহক নির্বাচন না করলে এই খেলাপি সংকট ও ঋণ আদায়ে কখনো সুফল আসবে না," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে ঋণ আটকে আছে ৪,২৮৪ কোটি টাকা। এই খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে চলতি ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০০ কোটি টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটি আদায় করেছে মাত্র ২৬ কোটি টাকা।
এইসঙ্গে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে রাইট-অফ ঋণ থেকে ৫০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৩৯ কোটি টাকা।
এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহক থেকে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ৩৩৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ৬৫ কোটি টাকা বা মাত্র ১৯ শতাংশ আদায় হয়েছে।
তবে প্রতিষ্ঠানটি লক্ষ্যমাত্রা খুবই সীমিত আদায় করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি ঋণ আদায় করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৩ সালের জুন-ভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্টয়ত্ত পাঁচটি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ৭৪,৪৫৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৫ শতাংশ। যদিও বর্তমানে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮.১৬ শতাংশ।