ফের বাড়ল নীতি সুদহার, বাড়বে ঋণের খরচ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭.৭৫ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বেসরকারি খাতে ঋণ নেওয়ার খরচও বাড়বে।
এর আগে গত অক্টোবরে নীতি সুদহার ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭.২৫ শতাংশ করা হয়। সেই হিসাবে দুই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে নীতি সুদহার ১২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে ঋণ দেয়, তা-ই রেপো রেট বা নীতি সুদহার।
এছাড়া ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে সব খাতে স্মার্ট-এর (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অভ ট্রেজারি বিল) সঙ্গে প্রযোজ্য বিদ্যমান মার্জিন ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গ্রাহকদের এখন ১১.১৮ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এর অর্থ, ঋণের খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতের ব্যবসা করার ব্যয়ও বাড়বে।
নতুন সুদহার সোমবার (২৭ নভেম্বর) থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
২২ নভেম্বর মুদ্রানীতি কমিটির প্রথম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার লক্ষ্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে এবং জুনের মধ্যে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা।
প্রায় একই সময়ের মধ্যে, বা গেল বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ১১ বার সুদহার বাড়িয়েছে। এছাড়া প্রতিবেশী ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও গত মে মাসে সুদহার একেবারে ২৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ায়। উল্লেখযোগ্যভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরও এ দুটি অর্থনীতি তাদের সুদহার উচ্চ পর্যায়েই রেখেছে।
মুদ্রানীতি-বিষয়ক সভায় উপস্থিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, নীতি সুদহার বাড়ানোর পর তার প্রভাব দৃশ্যমান হতে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগে। অক্টোবরের শুরুতে যে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছিল, তার প্রভাব ধীরে ধীরে দেখা দিতে শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা বলেন, 'রোববার যে পলিসি রেট বাড়ানো হলো, অর্থনীতিতে এর প্রভাব পেতে আমাদের আগামী বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের প্রক্ষেপণ হচ্ছে, দুই দফায় পলিসি রেটে বড় উল্লম্ফন হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।'
প্রভাব দৃশ্যমান হতে কিছুটা সময় লাগবে
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট ও ঋণের সুদহার বাড়ানোর অন্যতম উদ্দেশ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। তবে এটা বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে কিছুটা সময় লাগবে।'
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরাসরি গ্রাহক পর্যায়ের ঋণের সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে যা গ্রাহকের কস্ট অভ ফান্ডে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। 'অন্যদিকে পলিসি রেট বাড়ায় ব্যাংকগুলোর ফান্ড কস্ট বাড়বে, তখনও গ্রাহকের ঋণের খরচ বাড়বে।'
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সুদহার বাড়ানোর এর কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। যার প্রভাব নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতেও পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, 'নীতি সুদহার বাড়ার কারণে আমানতের সুদহার আরও বেড়ে যাবে। তখন গ্রাহকদের মধ্যে খরচ কমিয়ে দিয়ে সঞ্চয়ের প্রবণতা তৈরি হবে।'
মূল্যস্ফীতির ওপর নীতি সুদহারের পরিবর্তন কেমন প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর একটি গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এতে বলা হয়, নীতি সুদহার প্রতি ১ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ালে বিপরীতে প্রথম বছরে মূল্যস্ফীতি ০.৫ শতাংশীয় হারে কমে এবং মুদ্রার বিনিময় হার ১ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমে ০.৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে।
কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ ও আমদানির খরচ বাড়ার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন নীতি সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে ধীরে চলার নীতিতেই অটল ছিল।
সর্বশেষ এমন এক সময় নীতি সুদহার বাড়ানো হলো যখন টানা দশ মাসের মতো বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা এবং ব্যাংকে ঋণযোগ্য তহবিল কমে যাওয়ায় সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন ৯.৬৯ শতাংশে পৌঁছেছিল।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা সিইও এবং পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, 'পলিসি রেটের এই বৃদ্ধিটা আরও বছরখানেক আগে হলে বাজারের জন্য ভালো হতো। এখন পলিসি রেটের বৃদ্ধি ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেবে, যেটা ঋণের চাহিদা কমিয়ে দেওয়ার কথা। তবে আমরা এখনই খুব বেশি ঋণের চাহিদা দেখছি না। কোনো প্রকল্প চালু হওয়ার জন্য বড় ঋণের চাহিদা একরকম নেই বললেই চলে।'
শরিয়াভিত্তিক একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, সুদহার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় মানুষ ব্যয়ও কমিয়ে দিচ্ছে। বাজারে কিছু পণ্যের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় বাড়তে থাকায় চলতি বেশ কিছু পণ্যের দাম খানিকটা কমছে বলে জানান তিনি।
ওই ব্যাংকার বলেন, 'বিশ্ববাজারে সুদহার অনেক বেড়েছিল, যার কারণে মূল্যস্ফীতি তাদের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। আমাদের আরও পলিসি রেট বাড়তে হবে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।'
সুদহার বাড়লে বেসরকারি খাতে বেশ প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে বেসরকারি খাতের নতুন করে নেওয়া ঋণের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি নয়। টাকার ব্যবহার কমে এলে মানুষ জমি কেনা, ভবন তৈরি করা, স্বর্ণ কেনাসহ বড় বড় ব্যয় কমিয়ে আনবে বলে জানান তিনি।
'শুধু পলিসি রেট বাড়িয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন'
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে. মুজেরী বলেন, 'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বের সব দেশেই পলিসি রেট বাড়ানোর প্রচলন আছে। আমরাও সে পথে হেঁটেছি। তবে আমাদের দেশে শুধু পলিসি রেট বাড়িয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। এখানে একটি গোষ্ঠী বাজারকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া অর্থনৈতিক খাতে সুশাসনের অভাব আছে।
'প্রভাবশালী একটি পক্ষ অনিয়ম করে আর্থিক খাতকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, এর জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।'
নীতি সুদহার বাড়ানোর যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পড়ে অর্থনীতিতে
আমানত ও ঋণের সুদহার বাড়বে: ঋণের সুদহার নির্ধারণে সুদের হারের মার্জিন বাড়ানোর কারণে ঋণের সুদহার বাড়বে। ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে মানুষ এখন ব্যাংক আমানতে রিটার্ন বেশি পাবে এবং ব্যাংক খাতে আমানত বাড়বে।
আন্তঃব্যাংক সুদহার বাড়বে: নীতি সুদহার বাড়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি আন্তঃব্যাংক ঋণের সুদহারও বাড়াবে ব্যাংকগুলো। রোববার (২৬ নভেম্বর) আন্তঃব্যাংক ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোকে ৮.১৯ শতাংশ সুদ দিতে হয়েছে। ব্যাংকাররা বলছেন, এই সপ্তাহে এটি ৮.৭০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে।
তারল্য বাড়বে: ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা এখন নতুন ঋণ নিতে কম আগ্রহ দেখাবে, অন্যদিকে আমানতের পরিমাণ বাড়বে। ফলে ব্যাংকগুলোতে চলমান তারল্য সংকট কমবে।
ডলারের চাহিদা কমবে: ব্যবসায়ীরা সাধারণত আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। সুদের হার বাড়ানোর প্রভাব হিসেবে ব্যবসায়ীরা এলসি কম খুলবেন। ফলে ডলারের চাহিদা কমে আসবে।
ভোক্তা ব্যয় কমতে পারে: ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়লে বাড়ি বা গাড়ি কেনার মতো বড় বড় ব্যয়গুলো কমাতে পারেন ভোক্তারা।
কমতে পারে চাহিদা: চাহিদার পতনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হতে পারে।
বিনিয়োগ: উচ্চ সুদহারের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূল বিনিয়োগ কমাতে পারে, বা পেছাতে পারে। এতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেতে পারে।
পুঁজিবাজার: উচ্চ সুদহারের ফলে শেয়ারের দর কমতে পারে।
সরকারি অর্থায়ন: সরকারকে তার ঋণের জন্য উচ্চ সুদ দিতে হতে পারে, এতে সরকারি ব্যয় ও বাজেট ঘাটতি বাড়তে পারে।
আবাসন বাজার: উচ্চ সুদহারের ফ্ল্যাট, প্লট বা জমি কেনার খরচও নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।