নুর উদ্দিন: ব্যবসায়ী থেকে যেভাবে এখন পুরস্কারজয়ী ধাতব রপ্তানিকারক
২০০২ সালের কথা। কলেজ জীবন শেষ করে বাবার কাছ থেকে মাত্র দুই লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নামেন চট্টগ্রামের মো. নুর উদ্দিন। প্রথম দিকে দেশের বাজারেই সীমাবদ্ধ ছিল তার এই ব্যবসা। পর্যায়ক্রমে বড় হতে হতে এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশের বাজারেও ধাতব পণ্য রপ্তানি করছেন তিনি। সম্প্রতি তার কোম্পানি এনআর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় তিন কোটি ডলার মূল্যের ধাতু রপ্তানি করার জন্য 'ন্যাশনাল এক্সপোর্ট গোল্ড ট্রফি' জিতেছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে নুর উদ্দিন তার এই যাত্রার গল্প শুনিয়েছেন।
নুর উদ্দিনের বাবাও তারের ব্যবসা করতেন। ২০০২ সালে ২২ বছর বয়সে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাগরিকা রোডে নিজস্ব একটি দোকান দেন নুর উদ্দিন। প্রথম দিকে তিনি সীতাকুণ্ড উপকূলে ভাঙা জাহাজের ব্যবহৃত তার সংগ্রহ করে সেগুলো বিক্রি করতেন।
২০০৭ সালে তাইওয়ানের এক গ্রাহকের সঙ্গে নুর উদ্দিনের যোগাযোগ হয়। আর এটাই মোড় ঘুরিয়ে দেয় তার ব্যবসার। তিনি প্রথমবারের মতো তাইওয়ানে তামার তারের একটি চালান পাঠান। এতে সাফল্য পাওয়ায় সীতাকুণ্ডের শিপ-ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে বিভিন্ন ধাতুর টুকরা সংগ্রহ করে সেগুলো বিভিন্ন দেশে রপ্তানির কথা মাথায় আসে নুর উদ্দিনের।
তখন থেকেই এ পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে থাকেন নুর উদ্দিন। ২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে দেশের অন্যতম বৃহৎ ধাতু রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। গত ৮ নভেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি প্রতিষ্ঠানটির হাতে 'ন্যাশনাল এক্সপোর্ট গোল্ড ট্রফি' তুলে দেন।
নিজেকে একজন নেতৃস্থানীয় ধাতু রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি নুর উদ্দিন জাহাজের বিভন্ন সরঞ্জামের পুনর্ব্যবহার এবং গার্মেন্টের আনুষঙ্গিক শিল্পে বিনিয়োগ করে ব্যবসায় বৈচিত্র্যে আনেন। তার কোম্পানির এখন তিনটি শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডসহ সাতটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগ রয়েছে। তার কোম্পানিতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষের।
নুর উদ্দিন তার ব্যবসায়ী থেকে পুরস্কারজয়ী রপ্তানিকারক হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জগুলোর কথা তুলে ধরেন। টিবিএসের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, 'যখন আমি খুব অল্প বয়সে ব্যবসা শুরু করি, তামা ছাড়া অন্যান্য ধাতু সম্পর্কে খুব কমই জানতাম। বিভিন্ন ধরনের ধাতু এবং তাদের গ্রেড সম্পর্কে জানতে কয়েক বছর সময় লেগেছে।'
তিনি বলেন, 'প্রথম দিকে আমি ঢাকার বিভিন্ন ক্রেতার কাছে খুব কম মূল্যে টুকরা টুকরা তামার তার সরবরাহ করতাম। পরবর্তীকালে আমি তারের কারখানাগুলোর সাথে যোগাযোগ করি এবং সরাসরি তাদের কাছে তামা সরবরাহ শুরু করি। এতে যথেষ্ট পরিমাণে লাভ হয়। সেই সময় আমি জানতাম না যে টুকরা টুকরা ধাতুও বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা যেতে পারে।'
২০০৭ সালে নূর উদ্দিনের সাথে তাইওয়ানের একজন ধাতু ক্রেতার সাথে দেখা হয়। তার কাছে ২০ টন ওজনের টুকরা টুকরা তামা রপ্তানি করেন তিনি। পরবর্তীকালে তার ভাইও ব্যবসায় যোগ দেন। এবার তাদের ব্যবসায় তামার তারের সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন সরঞ্জাম, পিতল, স্টেইনলেস স্টীল, ব্রোঞ্জ এবং অ্যালুমিনিয়াম রপ্তানি।
রপ্তানি কর্মজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ধাতব গ্রেড এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় ন্যায্যমূল্যের জন্য ক্রেতাদের সাথে দরকষাকষি করতে পারতেন না তারা। মূল্য নিয়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই ভারতীয় ক্রেতাদের কাছে তারা পণ্য রপ্তানি করতেন। একপর্যায়ে তারা ধাতুর গ্রেডিং এবং বিভিন্ন গ্রেডের ধাতুর জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতার খোঁজ করেন।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি চীন, জাপান, স্পেন, ফিলিপাইন, কোরিয়া, বেলজিয়াম, ভারতসহ আরো অনেক দেশে শতভাগ বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা সহ গ্রেডেড ধাতু রপ্তানি করছে।
নুর উদ্দিন রপ্তানির সময় যেসব অসুবিধার সম্মুখীন হন, বিশেষ করে কাস্টমসের চালান নিয়ে জটিলতার কথা তুলে ধরেন। ধাতু রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা সত্ত্বেও তারা প্রায়শই উপেক্ষিত এবং মাঝে মাঝে হয়রানির শিকার হন বলে জানান।
ধাতু রপ্তানি খাতের সম্ভাবনা নিয়ে নুর উদ্দিন বলেন, 'বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ কোটি ডলারের ধাতু রপ্তানি হয়। তিনি বিশ্বাস করেন, সরকারের কাছ থেকে যথাযথ নীতি এবং কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই আয়কে দ্বিগুণ করা সম্ভব।'
এ খাতের সক্ষমতা বাড়াতে নুর উদ্দিন আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ মূল্যের ইংগট (ধাতুপিণ্ড) উৎপাদনের জন্য ধাতু গলানো এবং গ্রেড করার জন্য কারখানাগুলোতে শিল্প গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তার কথা এ ধরনের সুবিধাগুলো কেবল কর্মসংস্থানের সুযোগই তৈরি করবে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতির অগ্রগতিতেও ভূমিকা রাখবে।
জাহাজের বিভিন্ন সরঞ্জামের পুনর্ব্যবহার শিল্পের পাশাপাশি নুর উদ্দিনের এনআর গ্রুপ গার্মেন্ট সংশ্লিষ্ট খাতেও বিনিয়োগ করেছে, যা শতভাগ রপ্তানিমুখী উদ্যোগ। তিনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে রপ্তানির জন্য নতুন নতুন পণ্য অনুসন্ধানের আহ্বান জানান।