ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্য কমেছে
বাংলাদেশের ১০টি ইসলামী ধারার ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যিক লেনদেন বেশ কমেছে। এছাড়া, ব্যাংকগুলোর ঋণ তাদের আমানত সংগ্রহের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি বেশি, যার কারণে চাপে পড়েছে ব্যাংকগুলোর তারল্য।
এই ব্যাংকগুলোর তহবিলের একটি বড় অংশ দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ বা ঋণে আটকে থাকায় তারা স্বল্পমেয়াদী আর্থিক বাধ্যবাধকতা পূরণে জটিলতার মুখে পড়তে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যেও এ বিষয়টি উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রপ্তানি প্রায় ৩৯% কমেছে; যা এর আগের ত্রৈমাসিকে কমেছিল ৯.২৬%।
অথচ একই ত্রৈমাসিকে সামগ্রিক রপ্তানি প্রায় ৭% বেড়েছে, যা উঠে এসেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে।
এছাড়া জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশের মোট আমদানি ২৫% কমলেও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি কমেছে ৪৭%।
ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কেন কমছে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, নানা অনিয়মের কারণে এই ব্যাংকগুলো নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা আস্থার সংকট হয়েছে।
"যেসব ব্যবসায়ী লাখ লাখ ডলারের এক্সপোর্ট করেন, তারা অবশ্যই ব্যাংক খাত নিয়ে খবরাখবর রাখেন। তাই এক্সপোর্ট করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে পেমেন্ট ঠিকমতো পাবেন কিনা, সেটি তারা মাথায় রাখেন," বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এক বছরে ডিপোজিট আউটস্ট্যান্ডিং বাড়াতে পেরেছে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। ইয়ার অন ইয়ার ডিপোজিটের গ্রোথ মাত্র ০.৮৫%।
অন্যদিকে, এই ব্যাংকগুলো এক বছরে লোন ডিসবার্সমেন্ট আউটস্ট্যান্ডিং বাড়িয়েছে ৩২৩ কোটি টাকা, গ্রোথ ৮.৭৩%। অর্থাৎ, গত এক বছরে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ডিপোজিট বাড়াতে পেরেছে, লোন বাড়িয়েছে তার প্রায় ১০ গুণ।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও জাফর আলম টিবিএসকে বলেন, "অন্য ব্যাংকগুলোর কথা জানি না, আমাদের ব্যাংকে ডিপোজিট বাড়াতে নতুন অনেক প্রোডাক্ট ইনট্রোডিউস করা হয়েছে। এখন আমরা ধীরে ধীরে ডিপোজিট বাড়াতে সক্ষম হচ্ছি।"
ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো থেকে অনিয়ম করে লোন দেওয়ার অভিযোগ আছে। এসব কারণে গ্রাহকেরা ডিপোজিট করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে ভরসা করতে পারছে না।
সবমিলিয়ে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য কমছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯১% কমে ১০৭৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আগের তিন মাসের তুলনায় ১০টি ইসলামী ধারার ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে ৫টি ব্যাংকের কোনো অতিরিক্ত তারল্য নেই, উল্টো এই ব্যাংকগুলো ঘাটতিতে পড়েছে।
মেজর সব ইন্ডিকেটরে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি থাকলেও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো চমক দেখিয়েছে রেমিট্যান্সের ডলার আয়ে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকগুলোতে রেমিট্যান্সের গ্রোথ হয়েছে ৩৯% এর বেশি।
ইসলামী ধারার একটি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "আমাদের অনেক ব্যাংকের বকেয়া ইমপোর্ট বিলের পরিমাণ বেশি। ফলে আমাদের এখন অনেক ডলার প্রয়োজন হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশি রেট দিয়ে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে হচ্ছে। এখন বাজারের অবস্থা এমন, যে ব্যাংক বেশি রেট দেবে তারা বেশি রেমিট্যান্স পাবে। এসব কারণেই আমাদের ব্যাংকগুলোতে রেমিট্যান্স বেড়েছে।"
বর্তমানে রেমিট্যান্সের ডলারের অফিশিয়াল রেট ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। তবে অনেক ব্যাংকই সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা রেটে রেমিট্যান্স কিনছে।
জাফর আলম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ব্যাংকে রেমিট্যান্সের ইয়ার অন ইয়ার গ্রোথ হয়েছে প্রায় ৪০০%। রেমিটারদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কারণে আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ছে।"
আহসান এইচ মনসুর বলেন, "ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর অবস্থা কিন্তু এমন ছিল না। মূল সমস্যা শুরু হয় মালিকানা পরিবর্তন থেকে। অধিকাংশ ইসলামী ধারার ব্যাংকের মালিকানা একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে। গ্রুপটি মালিকানায় আসার পর নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপ দিনদিন খারাপ হচ্ছে।"
ইন্ডিকেটরগুলো খারাপ হওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো লং টার্ম দায় মেটাতে সমস্যায় পড়বে কিনা জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, তারা অবশ্যই সমস্যায় পড়বে।
"ব্যাংকগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হওয়ার কারণে ডিপোজিট সেভাবে আসছে না। আবার মালিকপক্ষের খোলা আমদানি এলসির দায় মেটাতে ব্যাংকগুলো বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্স নিয়ে আসছে। গুড গভর্নেন্স নিয়ে না আসলে ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো হবে না," বলেন তিনি।